রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না পেলেও নতুন রূপে পরিচিতি পাচ্ছে ‘সালুটিকর বধ্যভূমি’

রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না পেলেও নতুন রূপে পরিচিতি পাচ্ছে ‘সালুটিকর বধ্যভূমি’

বিশেষ প্রতিবেদন:
রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না পেলেও নতুন রূপে পরিচিতি পাচ্ছে সিলেটের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর ব্যক্তি উদ্যোগে এ বধ্যভূমিকে সংরক্ষণ করে বেসরকারিভাবে একটি শহিদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণ করা হচ্ছে। সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনে এ অরক্ষিত বধ্যভূমিটি বর্তমানে ‘সালুটিকর বধ্যভূমি’ হিসেবে পরিচিত। তবে এখন থেকে এটি পরিচিতি পাবে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যান’ হিসেবেও। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুস সালাম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদের উদ্যোগে বেসরকারিভাবে এ শহিদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণ করা হচ্ছে। আগামী শনিবার উদ্যানটি উদ্বোধন করা হবে। এরইমধ্যে এ উদ্যানে একটি নান্দনিক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। 

স্মৃতিস্তম্ভের দু’পাশে গণকবরে শায়িত বীর শহিদদের নামফলকের ভিত সারি সারি করে বসানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৭২জন শহিদের নামফলক বসানোর কাজ চলছে। এরইমধ্যে এ গণকবরে ৬৫ জন শহিদের পরিচয় পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। নতুন করে কারো পরিচয় পাওয়া গেলে নামফলকে তাদের নাম অন্তুর্ভুক্ত করা হবে বলেও জানান তারা। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের সালুটিকর এলাকার বর্তমান ক্যাডেট কলেজ (তৎকালীন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সবচেয়ে বড় কয়েদী ক্যাম্প ছিল। পাক সেনাদের হাতে বন্দি বাঙালির শেষ ঠিকানা ছিল এটি। সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা, পেশাজীবী, সাধারণ জনগণ ও সংখ্যালঘু নিরীহ মানুষজনকে আটক করে নিয়ে আসা হতো এ কয়েদি ক্যাম্পে। এরপর শুরু হতো তাদের ওপর নির্যাতন। অমানবিক নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হতো মুক্তিকামী বাঙালিদের। এরপর এখানেই দেওয়া হতো গণকবর। নাম না জানা কয়েক হাজার শহিদের মরদেহের শেষ ঠিকানা ছিল এটি। 

স্বাধীনতার কয়েক বছর পরও এসব এলাকায় মানুষের হাড়, মাথার খুলি পড়ে থাকতে দেখেছেন স্থানীয়রা। ভয়াবহ নৃশংসতার সাক্ষী এ বধ্যভূমিটি স্বাধীনতার পর থেকে অরক্ষিত ছিল। অযত্ন, অবৈধ দখল, অবহেলা আর উদাসীনতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ বধ্যভূমি নিশ্চিহ্ন হতে চলছিল। এ বধ্যভূমিতে এসে চোখের জল ফেলেছেন অনেক শহিদের পরিবার। 

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো অনেকেইও জানেও না এটি ছিল তাদের স্বজনদের শেষ সমাধিস্থল। দীর্ঘদিন ধরে বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল সিলেটের স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষজন। কিন্তু সরকারে অবহেলায় অরক্ষিত অবস্থায়ই রয়েছে এ বধ্যভূমিটি। 

জানা যায়, সিলেট ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০০৭ সালে পুরো জায়গাটি চিহ্নিত করে। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। পরের বছর ২৩ নভেম্বর প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষে বিজয় দিবস থেকে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু করে। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা নাজুক হওয়ায় লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায় বধ্যভূমি ও নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি। অবশ্য সাধারণ মানুষের অজানা থাকলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের যাতায়াত ছিল এখানে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে গত বছরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এ স্থানটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীরপ্রতিক (অবসরপ্রাপ্ত) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। 

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সাংবাদিক অপূর্ব শর্মাকে নিয়ে শহিদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটি করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আব্দুস সালাম ও অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর উদ্যানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণাধীন এ শহিদ স্মৃৃতি উদ্যানের কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। আগামী শনিবার এ উদ্যানটি উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তরা। এরইমধ্যে সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করেছেন তারা। 

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উদ্যানের মাঝখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। দু’পাশে সারি সারি করে ৭২টি নামফলক বসানোর ভিত স্থাপন করা  হয়েছে। এছাড়াও জায়গাটি সংরক্ষণ করে চারপাশে সীমানা প্রাচীর দেওয়া হয়েছে। 

শহিদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্যোক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুস সালাম জানান, বধ্যভূমিটি আমাদের কেবল আত্মদানের স্মৃতি নয়। এটি আমাদের গর্বের, আবেগের। এখানে একটি শহিদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। এরইমধ্যে কাজ শেষ পর্যায়ে। আগামী শনিবার এটি উদ্বোধন করা হবে। 

তিনি আরো বলেন, গণকবরে শহিদ হওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় পেতে সিলেটের স্থানীয় পত্রিকাতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ৬৫ জন বীর শহিদের পরিচয় পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে তাদের নামফলক বসানো হবে। পরবর্তীতের আর কারো পরিচয় পাওয়া গেলে তাদের নাম ফলকও বসানো হবে। 

মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও গবেষকদের তথ্যমতে এ বধ্যভূমিতে শহিদ হওয়া ৬৫ জন বীর শহিদের পরিচয় পাওয়া গেছে। 

তারা হলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে ড. এ এফ জিয়াউর রহমান, হবিগঞ্জ জেলার আউশকান্দি এলাকার সেয়দ সাজিদ আলীর ছেলে সৈয়দ সিরাজ আবদাল, সিলেট নগরীর পুরাণলেন এলাকার উপেন্দ্র কিশোর সেনগুপ্তের ছেলে বিমলাংশও সেন, ছড়ারপাড় এলাকার আব্দুন নুরের ছেলে বাছির মিয়া, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দেউল গ্রামের মন্তাজ আলীর ছেলে নুরুল হুদা গউস, ইপিআর ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন, সিলেট নগরীর মুগলটুলা এলাকার মশরফ আলীর ছেলে সোনাওর আলী, মিরাবাজার এলাকার শারদাচরণ দেবের ছেলে শুভেন্দু শেখর দেব শংকর, একই এলাকার গিরিধারী চক্রবর্তীর ছেলে গির্বানী কান্ত চক্রবর্তী, তার ছেলে গকুলানন্দ চক্রবর্তী ও গঙ্গোত্রী চক্রবর্তী, খাদিমপাড়া দত্তগ্রাম এলাকার ইয়াকুব আলীর ছেলে সিদ্দিক আলী, একই গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে আব্দুর রব হীরা, মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার খলাগ্রামের সূর্যকুমার ধরের ছেলে সুরতিমোহন ধর, একই গ্রামের দীনরাম দেবের ছেলে নরেন্দ্র দেব, সিলেট নগরীর জল্লারপাড় এলাকার বলেনদ্র চন্দ্র রায়ের ছেলে শুভন্দ্র শেখর রায়, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ছোটদেশ এলাকার আছদ্দর আলীর ছেলে তোতা মিয়া, সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আনোয়ার পাত্রের ছেলে কুমেদ পাত্র একই গ্রামের কানতুর পাত্রের ছেলে ফরছন পাত্র, রবাই মিয়ার ছেলে ইসরাইল আলী, সৈয়দ আলীর ছেলে আব্দুর রহমান, কনাই মিয়ার ছেলে আব্দুল গনি, মুছন আলীর ছেলে রমজান আলী, সিলেট সদর উপজেলার ধোপাগুল এলাকার হামিদ উল্লার ছেলে হাজী আমজদ আলী, সিলেট নগরীর আখালিয়া ব্রাহ্মণশাসন এলাকার করুণাময় ভট্টাচার্য্যরে ছেলে কালিপদ ভট্টাচার্য্য, তার ছেলে হীরেন্দ্র ভট্টাচার্য্য, নগরীর নয়াটিলা এলাকার সদাই নমঃশুদ্রের ছেলে সুখাই নমঃশুদ্র, সিলেট সদর উপজেলার উমদারপাড়া গ্রামের আলাই মিয়ার মেয়ে ছুরেতুননেছা, একই গ্রামের ওয়াহাব উল্লার মেয়ে রহিমা বেগম ও খলিলা বেগম, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার খোজারখলা গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে তজমুল আলী। 

সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আব্বাস আলীর মেয়ে ময়না বিবি, গোয়াইনঘাট উপজেলার বীরকুলি গ্রামের ছমেদ আলীর ছেলে আব্দুল খালিক, সিলেট সদর উপজেলার লাখাউড়া গ্রামের হায়দার মিয়ার ছেলে আব্দুল মজিদ, একই উপজেলার পোড়াবাড়ি গ্রামের রামচরণ উড়াংয়ের সন্তান দূর্গা উড়াং ও ভাদুয়া উড়াং, একই গ্রামের লিব উড়াংয়ের সন্তান ঘাটমা উড়াং, একই উপজেলার বাবার হাট এলাকার কিশোরপাত্রের ছেলে শচীন্দ্রপাত্র, মহালদিক গ্রামের ছফর আলীর ছেলে আব্দুল গণি, সিলেট সদর উপজেলার লালবাগ এলাকার আব্দুল আলীর ছেলে জহির আলী, একই গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছেলে জফুর আলী, সিলেট সদর উপজেলার বালিয়াকান্দি গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল ছোবহান, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি গ্রামের সৈয়দ আহমদের ছেলে আব্দুল আলী, সিলেট সদর উপজেলার জৈনকারকান্দি গ্রামের ইব্রাহিম আলীর ছেলে সাজিদ আলী, একই উপজেলার বাউয়ারকান্দি গ্রামের সফর আলীর ছেলে আব্দুল গনি, গোয়াইনঘাট উপজেলার কচুয়ারপাড় গ্রামের উমেদ আলীর ছেলে আকবর আলী, একই গ্রামের ফুরকান আলীর ছেলে ইউসুফ আলী, সিলেট সদর উপজেলার দাফনাটিলা গ্রামের ইসরাইল আলীর ছেলে কুটি মিয়া, একই উপজেলার কালাগুল এলাকার কেয়ামত আলীর ছেলে সুরুজ আলী। 

সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর গ্রামের ফজল খানের ছেলে নুরুল হক খান, সিলেট সদর উপজেলার মহাজনপট্টি এলাকার গুরুচরণ মিত্রের ছেলে গজেন্দ্রলাল মিত্র, একই এলাকার মদনমোহন বণিকের ছেলে প্রাণ গোবিন্দ বণিক, শুধাংশু শেখর দত্তের ছেলে সুনীল দত্ত, সিলেট নগরীর সুবিদবাজার নয়াবস্তি এলাকার নারায়ন সিংহের ছেলে আনন্দ সিংহ, তার ছেলে খগেন্দ সিংহ, বড়বাজার রায় হোসেন এলাকর গরবা সিংহের ছেলে গৌরমোহন সিংহ, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কর্মকলাপতি গ্রামের বৃন্দাবন চন্দ্র দেবের ছেলে বসন্ত কুমার দেব, সিলেট নগরীর তাতীপাড়া এলাকার বংকেশ দাশ, সিলেটের ওসমানীনগর উপজলার তাজপুর রবিদাশ এলাকার গজেন্দ্র কুমার দেবের ছেলে মিহির লাল দেব ও মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার নন্দনগর গ্রামের আব্দুল গণি চৌধুরীর ছেলে আব্দুল আহাদ চৌধুরী। তাছাড়াও রয়েছেন আব্দুল্লাহ, খালেদ ও চৌধুরী। তাদের বাবার পরিচয় পাওয়া যায়নি।  -ডেইলি বাংলাদেশ