টাঙ্গুয়ায় পাখির নিরাপদ অভয়াশ্রম এলাকা চিহ্নিত করার দাবি

বিশেষ প্রতিবেদন :: জেলার সবচেয়ে বড় পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে ক্ষেত টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি সুরক্ষায় আইন ও প্রয়োগ থাকলেও বছরে বছরে কমছে পাখির সংখ্যা। জানা যায়, ২০১৯ সালের পাখিশুমারি অনুযায়ী হাওর ও এর আশপাশের এলাকায় ২০৮ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওরে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খ চিল, পাতি কুট ইত্যাদি পাখির বিচরণ হাওরে।
এছাড়া রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি জোড়া কুড়ুল। এই পাখির প্রজাতিটি বৈশ্বিকভাবে বিপন্ন। সারা দেশে এর নমুনাসংখ্যা ১০০টি হবে কি না সন্দেহ। ২০১১ সালের পাখিশুমারিতে এই হাওরে চটাইন্নার বিল ও তার খাল, রোয়া বিল, লেচুয়ামারা বিল, রুপাবই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না ও আন্না বিলে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮,৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয়। এই শুমারিতে অন্যান্য পাখির পাশাপাশি নজরে আসে কুট, মরচেরং ভুতিহাঁস, পিয়ংহাস, সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, লেনজা, ডুবুরি, পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখি।
এছাড়াও প্রতি বছরই টাঙ্গুয়ার হাওরে সমগ্র দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিরল কয়েক জাতের পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বৈকাল তিলিহাঁস, বেয়ারের ভুঁতিহাস এবং কালোলেজ জৌরালি। বাংলাদেশে দৃশ্যমান আটটি বেয়ারের ভুঁতিহাসের পাঁচটিই পাওয়া গেছে টাঙ্গুয়ায়। বিরল প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আরো আছে কালোপাখা টেঙ্গি, মোটাঠুঁটি ফাটানো, ইয়ার, মেটে রাজহাঁস, মাছমুরাল, লালবুক গুরগুরি, পাতি লালপা, গেওয়াল বাটান, লম্বা আঙুল চা পাখি, বড় গুটি ঈগল, বড় খোঁপা ডুবুরি, কালো গির্দি প্রভৃতি। উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের টাঙ্গুয়ার পাড়ের গ্রাম মাটিয়ান। এই গ্রামের বাসিন্দা দিন মজুর মো. ইমরান। ছোট বেলা থেকে এই টাঙ্গুয়ার পাড়েই বড় হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু মুনাফাখোর পাখি শিকারির কারণে পাখির সংখ্যা কমতির দিকে। ১৫ বছর আগেও এই হাওরে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করা হতো। এখন প্রশাসনের তৎপরতায় বন্দুক দিয়ে শিকার বন্ধ হয়েছে। তবে শিকারিরা পাখি ধরার জন্য নতুন নতুন কৌশল বের করেছে। এখন সূতা দিয়ে একধরণের ফাঁদ তৈরি করে শিকারিরা। এছাড়াও রাতে লাইট দিয়েও পাখি শিকার করা হয়।
একই রকমের অভিযোগ আরো অনেকের। হাওরে স্থানীয় জাতের পাখি সহ শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমতির দিকে। স্থানীয়রা বলছেন, পাখিদের খাবার সংকট, গাছ কেটে উজার করা, হাওরের সব জায়গায় পর্যটকদের বিচরণ করা ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলাচলের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখির সংখ্যা কমছে।
তাহিরপুর সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা শিক্ষার্থী আদনান হাবিব রাব্বি বলেন, শীতকালে পাখি দেখবার জন্য অনেক পর্যটক আসেন আমাদের তাহিরপুরে। গভীর হাওরে যেখানে পাখির বাস সেখানে স্পীডবোট নিয়ে ঘুরে দেখেন পর্যটকেরা। ফলে পাখি সেখানে থাকে না।
পাখিদের আবাস্থল হিসেবে টাঙ্গুয়াকে গড়ে তুলতে কি করা প্রয়োজন? এমন প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষার্থী বলেন, হাওরের গভীর এলাকাকে পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এসব অভয়াশ্রমে জন সাধারণের চলাচলে সম্পূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’র (আইইউসিএন) মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপু বলেন বলেন, শুধু সুনামগঞ্জ নয় সারাবিশ^ব্যাপী পাখির সংখ্যা কমছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে ১০-১৫ শতাংশ পাখি কমেছে সারাদেশে। সুনামগঞ্জে পাখি শিকারি ও পর্যটকরা পাখি নিরাপদে থাকার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ান। তবে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর পাখির জন্য নিরাপদ। টাঙ্গুয়াকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে স্থানীয় জনগণ সহ প্রশাসনকে আরো তৎপর হতে হবে।
তিনি বলেন, পাখির খাবার সারা বছর এক মহাদেশেও হয় না। কিছু পাখি আছে গ্রীষ্মে ও শীতে খাবারের জন্য একেক জায়গায় থাকে। আবার প্রজননের জন্য আলাদা জায়গায় থাকে। আবার একটি পাখি রাতে থাকে এক জায়গায়, খাবার আহরণ করে আরেক জায়গায়। পাখিরা সব সময় বিচরণ করে।
বাংলাদেশে পাখির সংখ্যা গত ১৫ বছরের মধ্যে ১০-১৫ শতাংশ কমে যাওয়ার তথ্য জানিয়ে সীমান্ত দীপু বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের সমস্যা নয়। বৈশ্বিক সমস্যায় সারা পৃথিবীতেই পাখি কমছে। তবে এ দেশ পাখির জন্য বেশ উর্বর। পরিযায়ী পাখিদের আবাস বিশেষ করে জলাশয় সংরক্ষণে পদক্ষেপ প্রয়োজন।’