রোপওয়েতে ভেসে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি

রোপওয়েতে ভেসে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি

সুনীল সিংহ আসাম গুয়াহাটি থেকে ফিরে : আসামের গুয়াহাটির আরেকটি পর্যটন ক্ষেত্র হলো ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত রোপওয়ে। এই রোপওয়ে দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ভিড় থাকে। এ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে মাত্র আট মিনিট। সড়কপথে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যেতে লাগে ঘণ্টাখানেক।

রোপওয়ে হলো এমন যান্ত্রিক পরিবহন পদ্ধতি, যার মাধ্যমে নদী ও পর্বত এলাকায় কেবিনে মানুষ বা জিনিসপত্র পারাপার করা হয়। আসামের এই রোপওয়ের দুটি কেবিন। একটি থাকে এপাড়ে আর অপরটি থাকে ওপাড়ে। যখন কেবিন পর্যটক বা যাত্রী বোঝাই করে ছাড়ে তখন একসাথে কেবিন ছাড়া হয়।

চীন, ভারত ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত এই পরিবহন মাধ্যমটি পরিচিত ‘গুয়াহাটি রোপওয়ে প্রজেক্ট’ হিসেবে। চালু হয়েছে ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট। যুক্ত করেছে উত্তর গুয়াহাটির সঙ্গে দক্ষিণ গুয়াহাটিকে।

রোপওয়ের পথে ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানটায় গাছগাছালিতে ভরা ছোট্ট এক সবুজ দ্বীপ। সেই দ্বীপে মন্দিরও আছে, জনবসতিও আছে। এই দ্বীপের নাম ‘উমানন্দ দ্বীপ’।

সনাতনী বিশ্বাস মতে, শিবের স্ত্রী দেবী পার্বতী এ দ্বীপে বিশ্রাম নিয়ে ছিলেন। পার্বতীর আরেক নাম উমা। আর বিশ্রামের সময় দেবী পার্বতী বা উমা আনন্দ উপভোগ করেছিলেন বলেই দ্বীপের নাম উমানন্দ। এটি নদীর বুকে বিশ্বের ক্ষুদ্র জনবসতির দ্বীপগুলোর অন্যতম। আকৃতির কারণে এটির নাম ময়ূর দ্বীপ রাখেন ব্রিটিশরা।

বাংলাদেশ থেকে আসা দর্শনার্থী মুক্তিযোদ্ধা ফরিদুজ্জামান খান ও মৃণাল বণিক জানান, গুয়াহাটি রোপওয়েতে চড়ে ব্রহ্মপুত্র পার হওয়া আসাম ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য একটা ভালো লাগার মুহূর্ত। ব্রিজের ওপর গাড়ি করে কিংবা নৌযানে নদী দেখা আর রোপওয়ের কেবিনে নদী দেখার অভিজ্ঞতা একদমই আলাদা। এর মাধ্যমে পাখির চোখে নদীর আসল সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হলো। এ অভিজ্ঞতা আজীবন মনে থাকবে।
দক্ষিণ গুয়াহাটির মূল ফটক পেরিয়ে রোপওয়ে স্টেশনে ঢুকতেই দেখা গেল একটি কেবিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রী কেবিনে উঠার পর যান্ত্রিক দিকগুলো পরখ করে নেয়ার পর সেই কেবিন চলতে শুরু করলো। কেবিনটি প্রথমে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো, এরপর গতি বাড়তে থাকলো। বদ্ধ কেবিনে কিছুটা গরম অনুভূত হলেও নিচে প্রবহমান ব্রহ্মপুত্রকে পাখির মতো করে দেখার সুযোগটা অভাবনীয় উচ্ছ্বাসে ভাসালো দর্শনার্থীদের। কয়েক মিনিটেই চলে এলাম তীর থেকে বহু দূরে। দূর থেকে দূরে সবুজ পাহাড়ি চাদরে চোখ আটকে যাচ্ছিল বারবার।
উমানন্দ দ্বীপ পার হতেই কেবিনের গতি বেড়ে যায়। এর মধ্যেই পাশের রোপওয়ে দিয়ে ফিরতে দেখা যায় অপর দিক থেকে ছেড়ে আসা কেবিনটিকে। দেখতে দেখতে উত্তর গৌহাটিতে পৌঁছে যায় কেবিন। কিছুটা সময় পর ফিরতি কেবিনে চড়ে বসলেন সবাই। ফের উমানন্দ দ্বীপ পেরিয়ে দক্ষিণ গুয়াহাটিতে পৌঁছে যায় কেবিন। কেবিন থেকে বেরোতে বেরোতে সবার মুখ যেন উচ্ছ্বাসে জ্বলজ্বল করছিল। এ এক ভিন্নরকম আনন্দ, ভিন্নরকম রোমাঞ্চ।
রোপওয়ের কর্মীরা জানান, সুইজারল্যান্ডে তৈরি এই কেবিনের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩২ জন দর্শনার্থী/যাত্রী চড়তে পারেন। প্রতিবার চালুর আগে কেবিনগুলোর নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো চেক করা হয়। যদিও জরুরি প্রয়োজনে কেবিন উদ্ধারে রেসকিউ ক্যাপসুল আছে।
প্রতিমাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বৃহস্পতিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এই রোপওয়ে চালু থাকে। টিকিট ইস্যু করতে হয় সোয়া ৮টা থেকে সাড়ে ১২টা এবং দেড়টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে। আসা-যাওয়ার (বোথ ওয়ে) টিকিটের মেয়াদ থাকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত।
স্থানীয় যাত্রী বা দর্শনার্থীদের কেবল ওয়ান ওয়ে টিকিটের দাম ১০০ রুপি, বোথ ওয়ে টিকিটের দাম ১৫০ রুপি। তিন বছরের শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন দর্শনার্থীদের টিকিট লাগে না। ৩ থেকে ১২ বছর ও ষাটোর্ধ্বদের টিকিটে ৫০ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়। বিদেশি পর্যটক বা দর্শনার্থীদের ওয়ান ওয়ে টিকিটের জন্য দিতে হয় ৩০০ রুপি এবং বোথ ওয়ে টিকিট বাবদ গুণতে হয় ৫০০ রুপি।

বাংলাদেশেও আছে রোপওয়ে, তবে বন্ধ :
বাংলাদেশেও আছে এমন রোপওয়ে। একমাত্র এই রোপওয়ে সিলেটের ভোলাগঞ্জকে সুনামগঞ্জের ছাতকের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ১৯ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রোপওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, চালু হয় ১৯৭০ সালে। ১১৯টি খুঁটির ওপর নির্মিত রোপওয়ে দিয়ে বাক্সভর্তি পাথর পরিবহন করা হতো। তবে নানান সমস্যা ও জটিলতার কারণে এই রোপওয়ে কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। তবে কিছু বিনোদনকেন্দ্রে ছোট পরিসরে চালু রয়েছে রোপওয়ে।সূত্র-দৈনিক সিলেটের ডাক