সিলেটে নৌকার পালে নতুনের হাওয়া
কাউসার চৌধুরী, অতিথি প্রতিবেদক : আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেটের ১৯ আসনের মধ্যে ৯টিতে নতুনদের বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সুনামগঞ্জে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান কবি ড. মোহাম্মদ সাদিক, সুনামগঞ্জের অপর আসনে প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহধর্মিণী হেভিওয়েট প্রার্থী ড. জয়া সেনগুপ্তার স্থলে বর্তমান আইজিপির সহোদর চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (আল আমিন চৌধুরী) আর মৌলভীবাজারে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও শিল্পপতি জিল্লুর রহমানকে নৌকার মাঝি হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। হবিগঞ্জের এক সময়ের প্রভাবশালী রাজনীতিক শরীফ উদ্দিন মাস্টারের পুত্র এডভোকেট ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েল এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী মনোনয়ন পেয়েছেন। আর এজন্যে ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, নেছার আহমেদ, শাহনেওয়াজ মিলাদ গাজী, আব্দুল মজিদ খানের মতো প্রভাবশালী প্রার্থীকে এবার বাদ দেয়া হয়েছে।
বাদ পড়াদের বিরুদ্ধে দলের নেতাকর্মীদের সাথে দূরত্ব, দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অভিযোগ আছে। একের পর এক নির্বাচনে সেই পুরনোদের প্রার্থী দেয়ায় তৃণমুলের নেতাকর্মীরাও ছিলেন অনেকটা ক্ষুব্ধ। এবার কয়েকটি আসনে পুরনোদের বাদ দিয়ে সেই স্থানে নতুন মুখ পেয়ে তৃণমূলে কিছুটা প্রাণ ফিরে এসেছে।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের প্রার্থী ড. মোহাম্মদ সাদিক গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সিলেটের ডাককে বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় জননেত্রী শেখ হাসিনার একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন-এজন্য তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ। আমি একেবারে একটি প্রান্তিক গ্রামের মানুষ। গ্রামেই আমার জন্ম। গ্রামের সন্তান হিসেবে গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে আমার সম্পর্ক অনেক পুরনো। স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথেও সম্পর্ক আছে। সামনের নির্বাচনে নেতাকর্মীসহ সকলকে সাথে নিয়ে মানুষের কাছে যাব, ঘরে ঘরে যাব।জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করব। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের পথেই আমার প্রচেষ্টা থাকবে।’
হবিগঞ্জ-২ আসনে এডভোকেট ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েল বলেন, একটি সুন্দর সমাজ গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কাজ করব। পিতা শরীফ উদ্দিন এমপির কথা স্মরণ করে বলেন, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জের উন্নয়নই হবে আমার মূল লক্ষ্য। জনগণের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক আরও দৃঢ় ভাবে গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাব।
মৌলভীবাজার-৩ আসনের মো. জিল্লুর রহমান বলেন, তারুণ্য নির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের যে অঙ্গীকার; আর সে পথের যাত্রায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাকেও এই যাত্রায় সঙ্গী করায় কৃতজ্ঞ। মৌলভীবাজার-রাজনগরবাসীর ভরসার জায়গা পরিপূর্ণ করতে সবাইকে সাথে নিয়ে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব। এলাকার উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করাই আমার লক্ষ্য।
ঘোষিত প্রার্থী এলাকায় দেখা গেছে, এবার সিলেট-২ (বিশ্বনাথ ওসমানীনগর) আসনে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তিনি ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এম. ইলিয়াস আলীকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপরে অনুষ্ঠিত ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি মহাজোটভুক্ত জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে ওই দুই নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী দেয়নি। দলীয় প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের কমতি ছিল না। হয়নি কাংখিত উন্নয়ন। এবার দলীয় প্রার্থী পেয়ে উজ্জীবিত বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর উপজেলার নেতাকর্মীরা।
সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে এবার নিয়ে দুবার মনোনয়ন পেলেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ। প্রথমবার ২০১৪ সালে দলের মনোনয়ন পেলেও শেষ পর্যন্ত মহাজোটভুক্ত জাতীয় পার্টির জন্যে তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। পরে জাপার সেলিম উদ্দিন বিনাভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরের বার নৌকার প্রার্থী হিসেবে হাফিজ আহমদ মজুমদার নির্বাচিত হন। এবার সেই পুরনো প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মাসুক উদ্দিন আহমদকেই বেছে নিল আওয়ামী লীগ।তার মনোনয়ন প্রাপ্তিতে এলাকার নেতাকর্মীরা উৎফুল্ল।
সুনামগঞ্জ-১ (ধর্মপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও মধ্যনগর) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট রনজিৎ চন্দ্র সরকার। ‘হঠাৎ রাজনীতি’তে আসা ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন রতন। অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন রতন এমন অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। রতনের এমন কর্মকান্ডে এক সময়ের ছাত্রনেতা রনজিৎ সরকারকে প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ। অবশ্য, রতন-রনজিতের সাম্প্রতিক দলীয় কর্মকান্ডে এলাকার নেতাকর্মীদের মাঝে বিভক্তি দেখা দেয়।
সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহধর্মিণী ড. জয়া সেনগুপ্তার স্থলে শাল্লা উপজেলা পরিষদের সদ্য পদত্যাগী উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে (আল আমিন চৌধুরী)
নৌকার মাঝি হিসেবে মনোনীত করা হয়। এই আসনে টানা অর্ধশতাব্দী ধরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ২০১৭ সালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে তার সহধর্মিণী ড. জয়া সেনগুপ্তা বিজয়ী হন। এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রয়াত স্বামীর আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন তিনি। কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুব্জ হওয়ায় বার বার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নির্বাচনী এলাকায় দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকায় নেতাকর্মীদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।তার অসুস্থতার সুযোগে গড়ে ওঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিভক্তি দেখা দেয়। দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের মঞ্চে রেখেই তুমূল সংঘর্ষ হয়। ড. জয়া সেনগুপ্তার স্থলে এবার বেছে নেয়া হয় শাল্লা আওয়ামী লীগের এক সময়ের সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রয়াত আব্দুল মান্নান চৌধুরীর পুত্র আল আমিন চৌধুরীকে।
আল আমিন চৌধুরী মূলত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এতদিন দিরাইয়ে সংসদ সদস্য হলেও এবারই প্রথম বারের মতো শাল্লার কাউকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয়া হল।
সুনামগঞ্জ-৪ (সদর বিশম্ভরপুর) আসনে সর্বশেষ ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় পার্টির মমতাজ ইকবালের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখনকার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব মতিউর রহমান উপনির্বাচনে জয়ী হন। এরপরের টানা দুইবার এই আসনে মহাজোটের জাতীয় পার্টির প্রার্থী এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বিজয়ী হন। এবার এ আসনে নবীন প্রবীণ অনেকেই মনোনয়ন চাইলেও আওয়ামী লীগ বেছে নিয়েছে নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান নাগরী গবেষক কবি ড. মোহাম্মদ সাদিককে। সুনামগঞ্জ শহরতলীর ধারারগাও এর বাসিন্দা ড. সাদিক নৌকার প্রার্থী হওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীসহ প্রগতিশীল চিন্তার লোকজন আনন্দিত।
মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক, সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের উপর আস্থা রেখেছে আওয়ামী লীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ডাকসু’র সাবেক ভিপি,ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর একসময় এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে জয়ী হন। এক-এগারোর পরবর্তী সময়ে তাকে আর দল মনোনয়ন দেয়নি। নবম সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী নবাব আলী আব্বাস খান লাঙ্গল প্রতীকে জয়ী হন। এরপর দশম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মতিনকে নৌকার মাঝি হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়। তিনি বিজয়ীও হন। এরপর একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিকল্প ধারার এম এম শাহীন নৌকার প্রার্থী হলে ধানের শীষ নিয়ে ২০ দল তথা যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। সুলতান মনসুর ওই নির্বাচনে ধানের শীষে বিজয়ী হন। কিন্তু এবার আর শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলকেই মনোনয়ন দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নাদেলের মনোনয়ন প্রাপ্তিতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা দারুণ উজ্জীবিত।
মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসনে গেল নির্বাচনে দলের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নেছার আহমদকে বাদ দিয়ে শিল্পপতি ওলিলা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিল্লুর রহমানকে মনোনয়ন দেয়া হয়। তিনি রাজনগর উপজেলার কালাইকুনা গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রাজনগরের বাসিন্দা তোয়াবুর রহিম নৌকার প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। এরপর টানা ৫০ বছর পর আবারও রাজনগর থেকে নৌকার প্রার্থী মনোনয়ন দিল আওয়ামী লীগ।
হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে দলের কেন্দ্রীয় সদস্য ও হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজীর মৃত্যুর পর উপনির্বাচনেও ডা. মুশফিককে নৌকার প্রার্থী করা হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়ার কাছে অল্প ভোটে তিনি হেরে যান। এরপর টানা দুই বার নৌকার প্রার্থী হিসেবে দেওয়ান ফরিদ গাজীর পুত্র দেওয়ান শাহনেওয়াজ গাজীকে (মিলাদ গাজী) মনোনয়ন দেয়া হয়।এবার মিলাদ গাজীকে বাদ দিয়ে প্রবীণ নেতা ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরীর উপর আস্থা রেখেছে দল।
হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনে দলের জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট আব্দুল মজিদ খানের স্থলে প্রয়াত সংসদ সদস্য শরীফ উদ্দিন মাস্টারের পুত্র এডভোকেট ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েলকে পিতার জায়গায় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে দলের মনোনয়ন পেয়ে এই আসনে নির্বাচিত হন শরীফ উদ্দিন মাস্টার।তিনি হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হলেও ওই বছরের ৬ আগস্ট তিনি মারা যান। এরপর উপনির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী করা হয়। আব্দুল মজিদ খান টানা কয়েক মেয়াদ ধরে সংসদ সদস্য। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। মজিদ খানের ভরসা না রেখে শরীফ উদ্দিন তনয় ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েলের উপরই ভরসা করা হয়েছে।