ঈদ এলেই লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িতে শুরু হয় রং তুলির আঁচড়

ঈদ এলেই লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িতে শুরু হয় রং তুলির আঁচড়

রয়েল ভিউ ডেস্ক :
প্রতিবছর ঈদ এলেই ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় কয়েকগুণ। বহু বছরের পুরোনো গাড়ির বডিতে রং-চং দিয়ে নতুন করে সাজানো হয় যাত্রীদের আকর্ষণের জন্য। ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের চাপ বেশি থাকায় সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফিটনেসবিহীন বাসগুলোতে রং লাগিয়ে নামানো হয় রাস্তায়। রাজধানীর অধিকাংশ ওয়ার্কশপ বা গাড়ি মেরামতের কারখানায় এখন দারুণ ব্যস্ততা। সবখানেই চলছে পুরোনো ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলোকে রাঙানোর কাজ। হাতুড়ি পিটিয়ে সমান করা হচ্ছে বাসগুলোর বডি। তারপর তাতে দেয়া হচ্ছে নতুন রঙ। সেগুলো পরিণত হচ্ছে চকচকে ‘নতুন’ গাড়িতে। রং লাগানো এসব গাড়ি সড়কে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে কোথাও না কোথাও বিকল হয়ে পড়ে থাকে। ফলে বেড়ে যায় দুর্ঘটনা, তৈরি হয় যানজট। দুর্ঘটনার মূল কারণ এসব লক্কড়-ঝক্কড় এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, প্রতিবছরই ঈদযাত্রায় লঞ্চ ও ট্রেনের পাশাপাশি যাত্রীদের বাড়তি চাপ থাকে বাসে। আর এ সুযোগটাই কাজে লাগান বাস মালিকরা। সারাবছরের ত্রুটিযুক্ত বাসগুলোকে নতুন মোড়কে সাজিয়ে পরিবেশনের এই তো সময়। ঈদযাত্রায় প্রয়োজন প্রচুর যানবাহন, তা অপ্রতুল থাকায় বাস মালিকরা পুরোনো বাস নতুন চেহারায় পথে নামান। যেগুলোর হয়তো ফিটনেসই নেই, সেগুলোই স্রেফ রঙের ছোঁয়ায় চালিয়ে দেয়া হয় নতুন বাস হিসেবে। এসব গাড়ির কারণে ঈদে ঘরমুখো মানুষ রাস্তায় রাস্তায় ভোগান্তির শিকার হন।
 
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের ২০১৮ ও ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, ১ কোটি ১৫ লাখ মানুষ ঈদের সময় বাড়িতে গেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত দুই বছরে চার ঈদে মানুষ গ্রামে কম গেছে। প্রতি ঈদে কমপক্ষে ৬০ লাখ মানুষ গ্রামে যান। এর মধ্যে ঈদের আগে চার দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়েন। এ সময় প্রতিদিন বাসে ৮ লাখ, ট্রেনে ১ লাখ, লঞ্চে দেড় লাখ, ব্যক্তিগত গাড়িতে প্রায় ৪ লাখ, মোটরসাইকেলে প্রায় ৪ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়তে পারবেন। বাকি প্রায় ১২-১৩ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বে ট্রাক, ট্রেনের ছাদে করে। তখন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।

সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুর ১, ২ ও মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ, বসিলা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঈদযাত্রার চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। সারি সারি ফিটনেসবিহীন গাড়ি যেখানে খালি জায়গা পেয়েছে সেখানেই দাঁড়িয়ে রঙের কাজ হয়েছে। কোনো কোনো গাড়িতে টুংটং লোহার পিটুনির শব্দ পাওয়া গেলেও অধিকাংশ গাড়িতেই দেখা গেছে রঙের কাজকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

নিয়মানুযায়ী, মোটরযানের এক্সেল লোড, টায়ারের বিড, গতি, ব্রেক ও ধোঁয়ার রং, হেডলাইট, অ্যালাইনমেন্ট, রং, আসন সংখ্যাসহ ৬৫ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। কোনো মোটরযানের ফিটনেস সনদ না থাকলে ধরে নিতে হবে, সেটিতে ত্রুটি আছে। বাস শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের ব্যস্ততায় যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করতেই ফিটনেসবিহীন গাড়ি দিয়ে দেদার ব্যবসা চলে। ব্যস্ততার মধ্যে তখন কেউ আর ফিটনেসের খবর রাখে না। মূলত যাত্রীদের আকর্ষণ করার জন্যই গাড়িগুলোকে নতুন করে সাজানো হয়। তবে ফিটনেসবিহীন বাসে রং করে পথে নামানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বাস মালিকরা। তাদের দাবি ফিটনেস আছে, কিন্তু রং ফিকে হয়ে গেছে এমন বাসই কেবল রং করে পথে নামানো হচ্ছে।

দেশে প্রতিদিনি বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। রেজিস্ট্রেশন গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া তো আছেই। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দেশের সড়কে গাড়ি বেড়েছে প্রায় এক লাখ বলে জানায় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)।

বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, ২০১০ সালে দেশে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া যানবাহন ছিল ১৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৬৮টি। এক যুগ পর সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬টিতে। চলতি বছরের শুরুর দুই মাসে মাসে দেশে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে ৯৬ হাজার ৮৭৮টি গাড়ির। এর মধ্যে মোটরসাইকেল রয়েছে ৮৪ হাজার ৫৮৩টি, প্রাইভেটকার ৩১২৩টি, বাস ৬৪০টি, ট্রাক ৯৩৫টি, জিপ ১৬৫৪, মাইক্রোবাস ১৩২৫টি, পিকআপ ১৭৫১টি, কাভার্ড ভ্যান ৯২১টি।

বিআরটিএ’র পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখন নিবন্ধন পাওয়া অটোরিকশা আছে ৩ লাখ ৬ হাজার ১৪৮টি, মোটরসাইকেল ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪৮৮টি, প্রাইভেটকার ৩ লাখ ৮৫ হাজার ১১৩টি, মাইক্রোবাস ১ লাখ ৯ হাজার ৬৯৪টি, পিকআপ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৪টি, ট্রাক ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯২৩টি, বাস ৪৯ হাজার ৬৭৩টি, কাভার্ড ভ্যান ৪১ হাজার ৭৯৪টি।

প্রতি বছর গাড়ি বাড়ার কারণে প্রতিনিয়ত সড়কে দেখা দিচ্ছে তীব্র যানজট। সড়কে গাড়ি বাড়লেও বাড়ছে না সড়কের সংখ্যা। ফলে সড়কে যানজটের পাশাপাশি দুর্ঘটনা তো আছেই। আর ঈদ এলেও নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষের আরো ভোগান্তি বেড়ে যায়। এবারো ঈদের আগে বাড়ি ফেরা নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হবে বলে আগে ভাগেই রাজধানী ছাড়াছে সাধারণ মানুষ।

পরিবার-পরিজন নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে থাকেন মো. ইসমাইল হোসেন। এ বছর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে ঈদ উৎসবটা গ্রামেই কাটাতে চান। এজন্য রওনা হয়েছেন উত্তরবঙ্গের উদ্দেশে। তিনি বলেন, মহামারির কারণে গত দুই বছর গ্রামে ঈদ করতে পারিনি। এবার করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক। সে কারণে গ্রামে ঈদ করার মনস্থির করেছি। আমার মতো এমন অনেকেই এই চিন্তা-ভাবনা করেছেন। সে কারণে সড়কে যানজটসহ দুর্ভোগে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আগেভাগেই পরিবার-পরিজনকে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ইসমাইল একাই নন। তার মতো এমন ভাবনা শত শত নগরবাসীর। ঈদযাত্রার চাপ বাড়ার আগেভাগেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাড়ি ফেরার। এরইমধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে চলেও গেছেন।

জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ঈদের সময় পুলিশ শুধু যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার বিষয়েই জোর দেয়। এ কারণে যানবাহনের কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা, তা দেখা হয় না। এ সুযোগেই রাস্তায় আনফিট বাসের পাশাপাশি সিটি বাসও রাস্তায় নেমে পড়ে। শহরের বাস দূরপাল্লায় ও মহাসড়কে চললে সেগুলোর কারণে দুর্ঘটনা, যানজটের ঝুঁকি অনেকখানি বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা যথেষ্ট নজরদারি করছি যেন ঈদযাত্রায় যাত্রীদের কোনো দুর্ভোগ না হয়। তাই ফিটনেসবিহীন কোনো বাস যেন সড়কে না চলতে পারে, সেজন্য আমরা বিআরটিএ ও পুলিশ প্রশাসনকে যথেষ্ট সহযোগিতা করব। শুধু ঈদযাত্রায় নয়, কোনো সময়ই যেন ফিটনেসবিহীন বাস না চলতে পারে, সেজন্য আমরা সোচ্চার রয়েছি।