ঈদ ও সাম্য

ঈদ ও সাম্য

মুহাম্মদ ইমদাদুল হক ফয়েজী
সিয়াম সাধনাকারী মুমিন বান্দাদের পুরস্কার লাভের মহোৎসব ঈদুল ফিতর একেবারেই দোরগোড়ায়। সাদা-কালো, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু এককথায় সমাজের সকল শ্রেণি ও পেশার বান্দাগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদগাহে গিয়ে সালাত আদায় করবেন, পাশাপাশি বসে খুৎবা শুনবেন, মোনাজাত করবেন। ঈদগাহ থেকে শুরু করে সর্বত্র একে অপরকে বুকে জড়িয়ে আনন্দ-কুশল বিনিময় করবেন। এভাবে চলবে দুয়েক দিন।

ঈদের আনন্দ সবার। অবশ্য অসংখ্য মানুষ, তাদের সাধ্যের অনুপস্থিতির কারণে ঈদের আনন্দ-হাসিখুশি থেকে বঞ্চিত থাকেন। এমনকি নিজেদের প্রিয় সোনামণিদের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটানোর ইচ্ছে কেবল তাদের ইচ্ছেই থেকে যায়। একজন দু’জন নয় এমন অজস্র মানুষ আমাদের চারপাশে রয়েছেন। পাড়াপড়শী, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র আমরা তাদের দেখি। কেউ মুখ খুলে কিছু চান বা বলেন। আবার কেউ ধৈর্যের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে নীরবে-নিভৃতে বসে থাকেন। নিজেকে নিজের মাঝেই লুকিয়ে রাখেন। সমাজের এমন মানুষদের মুখে হাসি ফুটাতে ইসলামের ভূমিকা অনন্য, তুলনাহীন। যাকাত, সদকাতুল ফিতর, দান-সদকা, সাহায্য-সহযোগিতা এরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এগুলো তাদের অধিকার। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তাদের (ধনীদের) সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার। (সুরা জারিয়াত : ১৯)। আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফ, সদাচার ও আত্মীয়স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও অবাধ্যতা করতে বারণ করেন।’ (সূরা নাহল : ৯০)। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা বলেন, গোটা কোরআনের ব্যাপক অর্থজ্ঞাপক আয়াত হচ্ছে সূরা নাহলের এ আয়াতটি। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, জনৈক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল, ‘ইসলামের উত্তম কাজ কোনটি? রাসূল (সা.) বলেন, ‘কারও মুখে আহার তুলে দেওয়া।’ (বুখারি)। রাসূল (সা.) আরও বলেন, ‘ওই ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ (আদাবুল মুফরাদ)।

সুতরাং প্রতীয়মান হয়, বিত্তবানদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার রয়েছে। এটি নিছক তাদের প্রতি করুণা নয়। সামর্থ্যবানদের দায়িত্ব হচ্ছে, কোনো প্রকার অহমিকা-আত্মম্ভরিতা ব্যতিরেকে ফকির-মিসকিন, নিঃস্ব-দরিদ্র, অনাথ-অসহায়, এতিম-বিধবা, দরিদ্র- অভাবগ্রস্ত, নিকটাত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী তথা হকদার লোকদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের হাতে তাদের প্রাপ্য তুলে দেওয়া। খুশির কথা হচ্ছে, এগুলোর দ্বারা শুধু গ্রহীতা বা অধীকারীদের কষ্ট-ক্লেশ দূর হয়না বরং; সহযোগিতাকারীর ইবাদত ও সম্পদের ত্রুটিবিচ্যুতি মার্জনা হয়, পবিত্রতা ও সমৃদ্ধিও অর্জন হয়, বিপদ-আপদ দূর হয়, সর্বোপরি আল্লাহর সাহায্য ও ভালোবাসা লাভ হয় এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু হয়। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে সচেষ্ট হয়, মহান আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের পার্থিব কষ্ট বা বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামত দিবসে তার কষ্ট বা বিপদ দূর করে দেবেন।’ (বুখারি, মুসলিম)।
আমরা ঈদে নিজের জন্য, নিজের আদরের সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য সর্বনিম্ন একটি করে বা আরও অধিক পোশাক ক্রয় করি। অপচয় ছাড়া সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটায় ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। কথা হচ্ছে, যারা আমাদের এ কেনাকাটা দেখে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু একটি নিম্নমানের নতুন পোশাকের ব্যবস্থাটুকু করতে পারে না, হাত বাড়িয়ে একটু সাহায্য চায়, পিছু লেগে থাকে তারা আমাদের দয়া-মায়া কতখানি পায়? আমাদের আশে পাশে যে সকল অস্বচ্ছল, হতদরিদ্র তাদের কোমলপ্রাণ ছেলেমেয়েকে একটা গেঞ্জি বা প্যান্ট কিনে দিতে পারে না তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি-হƒদ্যতার পরশ কি ন্যূনতম হলেও থাকে?
আমাদের নবীজি (সা.) ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দানশীল, সর্বোত্তম কল্যাণকামী ও মহানুভবতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব। রাসূল (সা.) ইসলামকে কল্যাণকামিতার ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ছিলেন সকলের একান্ত আপনজন, অসহায়-দুঃখীজনের বন্ধু ও আশ্রয়স্থল। রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনোদিন কোনও সওয়ালকারীকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেননি। শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিমদের প্রতিও তাঁর দান-অনুগ্রহের হাত বিস্তৃত ছিল। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দানের হাত এতোটা প্রসারিত ছিল যে, আমার মনে হয়, সকাল বেলা যদি তার কাছে ওহুদ পরিমাণ সম্পদ রাখা হয়, তবে সন্ধ্যার আগেই তিনি সব দান করে দেবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)। রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা দান-সদকা, সহযোগিতা, পরোপকার তথা অন্যের কল্যাণ সাধন করতেন। আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর চেয়ে অধিক দয়ালু লোক দেখিনি।’ (মুসলিম)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,‘ মহিমান্বিত রমজান মাসে তার দান-সদকা অপরাপর মাসের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যেত।’ (বুখারি)।
আসুন, সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগী হই। ঈদআনন্দ ভাগাভাগি করি, হাসিখুশিতে দুর্বলদের শরিক করি। অসহায়দের সাধ পূরণে সচেষ্ট হই, সাধ্যানুযায়ী পাশে দাঁড়াই। মাহে রমজানের মহান শিক্ষা আত্মোপলদ্ধি ও সহমর্মিতায় উদ্ভাসিত হোক আমাদের সামগ্রিক জীবন। প্রেম-মমতা, সহানুভূতি-সহযোগিতায় সুশোভিত হোক পুরো পৃথিবী। নির্মল প্রীতি-ভালোবাসায় ভরে উঠুক উৎসব-ভালোবাসার মাহেন্দ্রক্ষণ ঈদুল ফিতর।
লেখক : শিক্ষক।