ওসি প্রদীপ দাসের বিরুদ্ধে বিভাগীয়  মামলা ॥ সুবর্ণার ইনক্রিমেন্ট স্থগিত 

ওসি প্রদীপ দাসের বিরুদ্ধে বিভাগীয়  মামলা ॥ সুবর্ণার ইনক্রিমেন্ট স্থগিত 

আদালতপাড়ায় অনৈতিক কাজ 


কাউসার চৌধুরী 
সিলেট সদর কোর্টে পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) প্রদীপ কুমার দাস ও কনস্টেবল সুবর্ণা দাস একে অপরের সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে অসদাচরণ ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ করেছেন মর্মে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাসের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। আর শাস্তিস্বরূপ কনস্টেবল সুবর্ণা দাসের ইনক্রিমেন্ট ৩ বছরের জন্যে স্থগিত করা হয়েছে।

সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ সিলেটের ডাককে জানান, তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনপ্রাপ্তির পর পরিদর্শক প্রদীপ কুমার  দাসের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরিদর্শক পদের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন অতিরিক্ত আইজিপি প্রদীপ দাসের বিষয়টি দেখছেন। কনস্টেবল সুবর্ণা দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তি স্বরুপ  তার ইনক্রিমেন্ট ৩ বছরের জন্যে স্থগিত করা হয়েছে। পুলিশের ভেতরে কেউ অপরাধ করে পার পাবে না বলে মন্তব্য এসএমপি কমিশনারের।

সূত্র জানায়, সিলেট সদর কোর্ট পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাস (বিপি-৬৩৮৬০৬০৪০৬) ও  কনস্টেবল সুবর্ণা দাসের (বিপি-৯৫১৫১৭৪০৯৩) বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টির পুরোপুরি সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্তে উল্লেখ করা হয়, গত ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর পরিদর্শক প্রদীপ এসএমপি'র সিলেট সদর কোর্টের নিজ সরকারি অফিসকক্ষে নারী কনস্টেবল সুবর্ণা দাসকে নিয়ে দরজা চাপিয়ে লাইট বন্ধ করে অবস্থান করছিলেন। সন্ধ্যা সোয়া ৭ টার দিকে পরিদর্শক প্রদীপ ওই নারী কনস্টেবলকে জড়িয়ে ধরেন। কনস্টেবলের শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেন তিনি। আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনৈতিক কাজের চিত্র এভাবেই তদন্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। 

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কনস্টেবল সুবর্ণা দাস ১ ডিসেম্বর দুপুরে ৬ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি ভোগের নিমিত্তে ছুটির সি.সি. নিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেন। কিন্তু, তিনি ছুটিতে না গিয়ে ওই দিন সন্ধ্যায় পুনরায় পরিদর্শক প্রদীপ দাসের সরকারি অফিস কক্ষে আসেন। বিভিন্ন সময়ে কনস্টেবল সুবর্ণাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন ওই পরিদর্শক। কনস্টেবল সুবর্ণা তদন্ত কমিটির নিকট এমন বক্তব্য দিলেও প্রদীপের ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেননি। এমনকি গেল ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর সংঘটিত ঘটনার বিষয়েও কনস্টেবল সুবর্ণা তার কর্মস্থল কোর্টের কোনো সহকর্মী বা তার নিয়ন্ত্রণকারী কোন কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে অবহিত করেননি। প্রতিবেদনে এ সকল বিষয় উল্লেখ করে মতামত দেন তদন্ত কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, ‘সিলেট সদর কোর্ট পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাস এর সরকারি অফিস কক্ষে একে অপরের সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়া, যা অসদাচরণ ও নৈতিক স্ফলনজনিত অপরাধ হিসেবে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের এহেন কার্যকলাপের কারণে পুলিশ সদস্য ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোপরি এ ঘটনাটি বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও  সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সুনাম চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিধায় তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলো।’ 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নগর পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ  কমিশনার সোহেল রেজার নেতৃত্বে গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনটি জমা দেন। কমিটির অপর দু’সদস্য হলেন,অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর প্রশাসন) গৌতম দেব ও কোতোয়ালি মডেল থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. সামছুদ্দিন ছালেহ আহমদ চৌধুরী পিপিএম।
সূত্রমতে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর পরই পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন অতিরিক্ত আইজিপি প্রদীপ দাসের বিষয়টি দেখছেন। কনস্টেবল সুবর্ণা দাসকে বিধি মোতাবেক তিন বছরের জন্যে তার ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়। বর্তমানে তাদের দু'জনেই নগর পুলিশ লাইনে সংযুক্ত রয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।   

সূত্রমতে, কুমিল্লা নগরীর কোতোয়ালি থানার কাদরপাড় লাকসাম রোডের মদন কুমার দাসের পুত্র প্রদীপ কুমার দাস ১৯৮৬ সালের ১০ জানুয়ারি উপ-পরিদর্শক (এসআই) নিরস্ত্র হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। চাকুরি বিধি অনুযায়ী চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর তার স্বাভাবিক অবসর গ্রহণ করার কথা। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডেও তিনি বসবাস করেন। তার সাথে যোগদানকারী উপ-পরিদর্শকদের মধ্য পদোন্নতি পেয়ে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপারও হয়েছেন। কিন্তু, অনিয়ম-অপকর্মের অভিযোগ থাকায় ওসি প্রদীপের কপালে আর সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ জুটেনি। 

২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারের  মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফের বাহারছড়ার শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হন। সিনহা রাশেদ হত্যাকান্ডের পর ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার থেকে একযোগে ৩৪ পুলিশ কর্মকর্তাকে দেশের বিভিন্ন ইউনিটে বদলি করা হয়। ৩৪ কর্মকর্তার একজন হলেন পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাস। কক্সবাজার কোর্ট থেকে তাকে সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি)-তে বদলি করা হয়। এসএমপি'তে যোগদানের পর কয়েকদিন নগর গোয়েন্দা শাখায় কাজ করলেও পরে সিলেট আদালতে পোস্টিং নেন। গত ১ ডিসেম্বর রাতে আদালতে নিজ কক্ষ থেকে নারী কনস্টেবলের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে আটক হন ওসি প্রদীপ। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয়। সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি) প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরে নারী কনস্টেবলসহ কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়ার ঘটনা ইতোপূর্বে  ঘটেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।