ওসমানীসহ সরকারী হাসপাতালে রোগীদের খাবারের বরাদ্দ বাড়লো ৫০ টাকা

ওসমানীসহ সরকারী হাসপাতালে রোগীদের খাবারের বরাদ্দ বাড়লো ৫০ টাকা
ফাইল ছবি

রয়েল ভিউ ডেস্ক:
দীর্ঘ এক দশক পর সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভাগের ৪৩টি সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য ভর্তিকৃত রোগীদের খাবারের বরাদ্দ ৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে একজন রোগীর খাবার বাবদ ১২৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা করা হয়েছে। ফলে বিভাগের সরকারী হাসপাতালগুলোতে রোগীরা কিছুটা হলেও উন্নত খাবার পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

গত ১০ অক্টোবর থেকে নতুন এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক ডা: হিমাংশু লাল রায়।
সর্বশেষ ২০১৩ সালে সরকারী হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের দৈনিক খাবারের বরাদ্ধ ৫০ টাকা বৃদ্ধি করে ১২৫ টাকা করা হয়েছিলো। এর আগে ১/১১ এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাধায়ক সরকারের আমলে ৫০ টাকা থেকে ২০ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হয়েছিল। ২০০১-এর আগে এ খাতে বরাদ্দ ছিল শয্যা প্রতি ৫০ টাকা।
তবে এবার বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মূল্য অনেক বৃদ্ধির ফলে দীর্ঘ ১ দশক পরে হাসপাতালের রোগীদের খাবারের জন্য ব্যয় বৃদ্ধি করল সরকার। ফলে এখন থেকে সরকারী হাসপাতালগুলোতে ভর্তিকৃত একজন রোগী দৈনিক ১৭৫ টাকার খাবার পাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থ বিভাগ গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সেটি গত ১০ অক্টোবর সারা দেশে বাস্তবায়ন করেছে। দ্রব্যমূল্য ও আনুষঙ্গিক খরচকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি প্রতি রোগীর দৈনিক খাবারে ১৪০ শতাংশ বরাদ্দ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছিল। অর্থ বিভাগ অবশ্য সংখ্যাটির ‘১’ কেটে দিয়ে বাড়িয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সর্বশেষ ২০১৩ সালে খাবারের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল। ঐ সময় সাধারণ স্কেলের ডায়েটের দৈনিক বরাদ্দ ৫০ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ১২৫ টাকা। তবে সেখান থেকে আবার ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কেটে, দেয়া হতো মাত্র ১০৬ টাকা। বর্তমানে ১৭৫ টাকা থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাদ দিলে থাকে ১৪৮ টাকা ৭৫ পয়সা। অর্থাৎ রোগীরা এ টাকায় দৈনিক ৩ বেলা খাবার পাবেন।
জানা গেছে, দেশের সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সকালের খাবারে দেয়ার কথা ১৫০ গ্রাম পাউরুটি, ৪ ইঞ্চির একটি কলা, ২০ গ্রাম চিনি ও একটি ডিম। কলা না পেলে সেক্ষেত্রে অন্য কোনো ফল ও জেলি দেয়ার কথাও জানিয়েছে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। দুপুর ও রাতের খাবারে প্রতি বেলায় মাছ বা মাংস দেয়ার কথা রয়েছে। তবে এক কেজির রুই বা কাতল মাছ থেকে পিসের আকার হতে হবে ১৪০ গ্রামের। ৩৪০ গ্রাম মুরগির মাংস, ৩৪০ গ্রাম চাল। এছাড়া মসুর ডাল ও সবজি দেয়ার কথা বলা হয়েছে নির্দিষ্ট পরিমাণে। যদিও অধিকাংশ সরকারী হাসপাতালে সরকার নির্দেশিত পরিমাণ খাবার দেয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। জিনিসপত্রের মূল্য, সরকারী বরাদ্দের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই রোগীদের খাবার দিতে হয় বলে জানিয়েছে হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা। বর্তমান বাজারে এই পরিমান খাবার নিশ্চিত করতে হলে ৩ থেকে ৪০০ টাকা বরাদ্দ লাগবে বলেও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
এদিকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী হাসপাতালগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খাবারের ব্যবস্থা করে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, প্রতি বছর দরপত্রের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারকে দিয়ে খাবারের জোগান দেয়। অঞ্চলভেদে দ্রব্যমূল্যের তারতম্য রয়েছে। ফলে সব হাসপাতালের দরপত্র এক হয় না। আবার শয্যার বাইরেও যেসব রোগী থাকে তাদের জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। সেই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। চলতি বছরের আগস্ট মাসে হাসপাতালের রোগীদের খাবারে বরাদ্দ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে রোগীদের খাবারে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। নির্ধারিত ১২৫ টাকা থেকে ১৪০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০০ টাকা বরাদ্দের আবেদন করা হয়। অর্থ বিভাগ সেখানে বরাদ্দ বাড়িয়েছে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ টাকা।
নগরীর ২টি সরকারি হাসপাতাল ও বিভাগের জেলা পর্যায়ের ২টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরাদ্ধ বৃদ্ধির চিঠি পেয়ে তা কার্যকরও শুরু হয়েছে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে উর্ধ্বগতি তাতে এই বরাদ্ধ বৃদ্ধি খুবই জরুরী ছিলো। তবে রোগীপ্রতি ব্যয় মাত্র ৫০ টাকা বৃদ্ধির ফলে খাবারের মান আহামরি কোন পরিবর্তন না হলেও আগের চেয়ে মাছ, গোশতের সাইজ তথা পরিমাণে কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান তারা। এছাড়া খাবারের অন্যান্য আইটেমে পরিবর্তন ও বৃদ্ধি ঘটেছে ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫০ বছর আগেও হাসপাতালে ৭ রকমের ডায়েট দেয়া হতো। সময়ের পরিক্রমায় তা বিলুপ্ত হয়েছে। দেশের সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য সঠিক ডায়েটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। রোগীভেদেও খাবারের পরিমাণ ও ধরণ ভিন্ন হওয়া উচিত। তবে যথাযথ পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে সরকারের বাড়ানো বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য সাধারণত ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ক্যালোরি খাবার প্রয়োজন। রোগভেদেও ডায়েটের ভিন্নতা রয়েছে। বিভিন্ন রোগীর জন্য অন্তত ৩ ধরনের ডায়েট দরকার। কিন্তু যে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে তাতে খাবারের পরিমাণ বাড়ানো কঠিন হবে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য মতে, সারাদেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ ১০, ২০, ৩১, ৫০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে ৪৮৫টি। মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০০ থেকে ২৫০ শয্যার ৬২টি জেলা, ৫০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল ও এক থেকে আড়াই হাজার শয্যার টারশিয়ারি (বিশেষায়িত) পর্যায়ের ৩০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ৪৯ হাজারের কিছু বেশি শয্যা। আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে শয্যা রয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৪টি। যদিও সরকারি হাসপাতালের মধ্যে মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি পর্যায়ের শয্যার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগে বর্তমানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মিলে ৪৩টি হাসপাতালে রোগী ভর্তি কার্যক্রম চলছে। এরমধ্যে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল, সরকারী কুষ্ট হাসপাতাল, টিবি হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ৩৪ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ছাতকের কৈতক ২০ শয্যা বিশিষ্ট পল্লী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী একসাথে সব হাসপাতালেই রোগীদের খাবারে ৫০ টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ১০ অক্টোবর থেকে সিলেট বিভাগের সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সদর হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে রোগীদের খাবারে বরাদ্দ ৫০ টাকা বাড়ানোর নির্দেশনা কার্যকর হয়েছে। হাসপাতালের খাবার মানগুলো টিক আছে কিনা সেটা যাছাই করার চেষ্টা চলছে। তবে বিষয়গুলো মূলত সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনগণ মনিটরিং করে থাকেন।
এ বিষয়ে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমরা নির্দেশনা পেয়েই বরাদ্দ অনুসারে খাবার বাড়িয়ে দিয়েছি। প্রতিদিনই ব্যাপারটি মনিটরিং করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বতর্মানে প্রত্যেক রোগীকে প্রতিদিন সকালের নাশতা হিসেবে ৫ পিস পাউরুটি, ২টি ডিম, ২টি কলা ও ১ প্যাকেট ছোট বিস্কুট দেয়া হচ্ছে। দুপুরে পরিবেশন করা হয় ভাত, মাছ, সবজি ও ডাল। বিকেলে ১ প্যাকেট ছোট বিস্কুট এবং রাতের খাবারের তালিকায় থাকছে ভাত, মুরগির মাংস, সবজি ও ডাল। আগে সকালে ১টি ডিম, ১টি কলা ও ৪ পিস পাউরুটি দেয়া হতো। দুপুরে ও রাতের খাবারে মাছ ও মাংসের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। আগে রোগীপ্রতি ৮০ গ্রাম মাংস দেয়া হতো এখন ১০০ গ্রাম পরিমাণ মাংস দেয়া হচ্ছে। একইভাবে মাছের পরিমাণও বেড়েছে।