‘চারদিকে থই থই পানি, কিন্তু খাওয়ার পানি কোথাও নেই’

‘চারদিকে থই থই পানি, কিন্তু খাওয়ার পানি কোথাও নেই’

রয়েল ভিউ ডেস্ক:
বানের পানিতে ভেসে গেছে ভাটির দেশ হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলার ২৪লক্ষ মানুষ। চারদিকে পানি থই থই করছে, বাড়ি ঘর, রাস্তাঘাট ডুবে গেছে, ফলে নিরাপদ খাওয়ার পানির একমাত্র উৎস টিউবওয়েল ডুবে গেছে, ভেসে গেছে মিঠা পানির পুকুরও।

এমন অবস্থায় বৃষ্টির পানি খেয়ে দিন পার করলেও গত তিন দিন ধরে বৃষ্টিপাত নেই বলেই চলে। ফলে পিপাসায় কাতরাচ্ছে বানভাসি মানুষগুলো। বন্যার পানি খেয়ে অসুস্থ হচ্ছেন অনেকেই।

জগন্নাথপুর উপজেলার সীরামিসি গ্রামের বাসিন্দা রোকেয়া পরিস্থিতির কথা জানাতে গিয়ে যেন এনসিয়েন্ট মেরিনার কবিতায় স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের কবিতার লাইনেরই উল্লেখ করলেন।

কোলরিজ বলেছিলেন, ওয়াটার ওয়াটার এভরি হোয়ার, বাট নট এ ড্রপ টু ড্রিংক। আর বানভাসি রোকেয়া বলেন, পানিতে গোটা এলাকা ভেসে গেছে। রাস্তার ওপর বসবাস করছি। এলাকার টিউবওয়েলগুলো পানির নিচে। চারদিকে পানি থই থই করছে, কিন্তু খাওয়ার পানি কোথাও নেই।
 
সুনামগঞ্জের স্থানীয় সংবাদকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী ফেসবুকে একটি ভিডিও আপলোড করে জানান, আতঙ্কের খবর হচ্ছে, সুনামগঞ্জে ভয়াবহ খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি ক্রমে ভয়াবহ হচ্ছে।’ তিনি দেশের মানুষকে খাবার, সুপেয় পানি, স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি নিয়ে সুনামগঞ্জে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, জেলার অন্যান্য উপজেলায় যখন পানি কমতে শুরু করেছে, তখন শাল্লা এখনো ডুবে আছে পানির নিচে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গাদাগাদি করে বসবাস করছে মানুষ। ভৌগোলিকভাবে দুর্গম এলাকা হিসেবে পরিচিত শাল্লায় এখনো পৌঁছায়নি বেসরকারি ত্রাণ। যদিও, সরকারি উদ্যোগে সামান্য পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে এখানকার মানুষ।

শাল্লা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী বিদ্যুৎ কুমার সরকার বলেন, এখানকার মানুষজন কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বন্যায় গোলার ধান নষ্ট হয়েছে, জমিতে থাকা বিভিন্ন ধরনের সবজি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বহু এলাকায় বানের পানিতে গরু ছাগল ভেসে গেছে। পুরো উপজেলার অবস্থা ভয়াবহ।

তিনি বলেন, সরকারি সাহায্যদানকারী ও উদ্ধারকারী কোনো টিম এখানে পৌঁছায়নি। এখন পর্যন্ত কোনো সংগঠনও শাল্লায় ত্রাণ নিয়ে পৌঁছাতে পারেনি।

শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, সরকার থেকে ৩০টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে ৩০০০ পরিবারকে রাখা হলেও আরও আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন।

তিনি জানান, উপজেলার আটগাঁও ও হবিবপুর ইউনিয়নে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। সেখানে আরও বেশি ক্ষতি হয়েছে।

সরেজমিনে শাল্লার বিভিন্ন মানুষজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, বহু মানুষ এখনো আশ্রয়হীন ও অভুক্ত আছেন। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকার কারণে কোন ধরনের সাহায্য চেয়ে তারা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। সবার বাড়ি-ঘর প্লাবিত হওয়ায় রান্না করারও কোনো সুযোগ নেই। ফলে গত কয়েক দিন ধরে কেবল শুকনো খাবার খেয়েই বেঁচে আছেন তারা।

এমন অবস্থায় কষ্টে রয়েছেন শিশু, বৃদ্ধ ও নারীরা। মা পর্যাপ্ত খাবার না খাওয়ায় দুধ পাচ্ছে না শিশুরা। পয়োনিষ্কাশন বা স্যানিটেশন বলতে কিছু নেই। উপজেলা জুড়ে পানিবাহিত রোগের ভয়াবহ সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। রীতিমতো মানবিক বিপর্যয় চলছে এখানে।

আশ্রয়কেন্দ্রে গুলোতে পা রাখার জায়গা নেই। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ ও পশু গাদাগাদি করে মানবেতর অবস্থায় আছে। ঘুমানো দূরে থাক, বসার অবস্থাও নেই। যেখানে ১০০-১৫০ মানুষ থাকার কথা, সেখানে কয়েক শ মানুষ ঠাঁই নিয়েছে।

শাল্লা উপজেলার সাধারণ মানুষের দাবি, প্রয়োজনের তুলনায় এখানে আশ্রয়কেন্দ্র খুবই কম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, এখানকার রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করেন না। তারা জনগণের জন্য ত্রাণ সহায়তা না দিয়ে ঘরে বসে আছেন। পাশাপাশি প্রতি বছর এখানে বন্যা দেখা দিলেও বন্যা প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

অন্যদিকে, জেলার সব কটি উপজেলায় কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। উপজেলা ভেদে ১২ কেজি ওজনের গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৩৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকায়, ৫ টাকার মোমবাতি ৫০ থেকে ১০০ টাকায়, আলু ও পেঁয়াজ ৮০ টাকা, চিনি ১৫০ টাকা, ডাল ২০০ টাকা, তেল ২৫০ টাকা।

বেশির ভাগ উপজেলায় বিদ্যুৎ না থাকায় প্রথম দিকে বিভিন্ন চার্জের লাইট, হারিকেন ও মোমবাতি জ্বালিয়েছেন অনেকে। এখন চার্জ শেষ হয়ে যাওয়া ও দোকানপাট বন্ধ থাকার কারণে কেরোসিন ও মোমবাতির সংকটে সন্ধ্যার পর থেকে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে পড়ছে এলাকা।

এ অবস্থায় বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ সদর আসনের জাতীয় পার্টির এমপি পির মিসবাহ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বাজার মনিটরিংয়ের বিষয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি ভিজিএফ কার্ড চালুর জন্যও সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

এদিকে, ছাতকে বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া মখলিছুর রহমানের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি উপজেলার উত্তর খুরমা ইউনিয়নের নাদামপুর (নানশ্রী বিলচরা) গ্রামের বাসিন্দা।

নাদামপুর গ্রামের পশ্চিমে বিতরকুলাই হাওরে গতকাল বৃহস্পতিবার তার লাশ ভেসে উঠেছে বলে জানান স্থানীয় এমপি মুহিবুর রহমান মানিক।

তিনি জানান, দোয়ারা বাজার উপজেলার সমুজ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী দুই ভাইবোন ছাড়াও ছাতক ও দোয়ারা বাজার উপজেলায় বন্যা ও বজ্রপাতে আরও ১০জনের ও বেশি মানুষ মারা গেছে।