চলার পথে মোবাইলে দৃষ্টি  বাড়ছে দুর্ঘটনা

চলার পথে মোবাইলে দৃষ্টি  বাড়ছে দুর্ঘটনা

আহমাদ সেলিম.
সকালে ঘর থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে অথবা কোন যানবাহনে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা আপন গন্তব্যে যাচ্ছেন অনেকে। কাজ শেষে অথবা দিনশেষে একইভাবে তারা আবার বাড়ি ফিরছেন। এই আসা-যাওয়া কিংবা রাস্তা পারাপারের সময় একদল তরুণ-তরুণী মোবাইলে কথা বলেন বা মেসেজ পাঠান। মোবাইলে দৃষ্টি রেখে ফেসবুক দেখেন। অনেকে এয়ারফোন লাগিয়ে কথা বলেন, গান শোনেন। অনেকে আবার রেললাইনও পার হচ্ছেন এয়ারফোন লাগিয়ে কথা বলতে বলতে। এতে ছোটখাটো দুর্ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি বিনাশ হতে পারে সুন্দর জীবনও। অপ্রত্যাশিত সেই ঘটনা একটি পরিবারের জন্য সারাজীবনের কান্না হয়ে যেতে পারে। 

মোবাইলের দিকে চেয়ে চেয়ে হাঁটছেন, মোবাইলে কথা বলতে বলতে সড়ক পার হচ্ছেন। কিংবা মোবাইলে কথা বলে গাড়ি পারাপার করছেন চালক-সিলেট নগরীর ভেতর এমন দৃশ্য সবার চোখে পড়ে হরহামেশা। চলার পথে মোবাইলের প্রতি এই আসক্তি তরুণ তরুণীদের মধ্যেই বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এর পরিণামে অনেক সময় জীবন দিতে হচ্ছে।

দেখা যায়, চারপাশে মানুষের ভিড়। তারা ব্যস্ততম সড়ক দিয়ে হাঁটছেন। হেঁটে হেঁটে হয়তো নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যে যাচ্ছেন। এই যাওয়া কিংবা আসার সময় তারা হয়তো মোবাইলে গুরুত্বপূর্ণ কাজও করছেন। তাই বলে এভাবে ঝুঁকি না নিয়ে অন্যভাবে সেই কাজটি সম্পন্ন করা যেতো। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, অফিস অথবা বাসায় বসেও কাজের সমাধান দেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু সেটি না করে তারা হাঁটছেন আর অবিরত মোবাইলে কাজ করছেন। হয়তো সেই কাজটিও গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জীবনের চেয়ে নয়। কারণ হাঁটার পথে শতভাগ মনোযোগ প্রয়োগ করার ফলে মুহূর্তের মধ্যে ভয়ংকর বিপদ চলে আসতে পারে। এতে একটি জীবন ঝরার সাথে একটি পরিবারের স্বপ্নও চিরদিনের মতো খান খান হয়ে যেতে পারে। 

বিষয়টি দিন দিন দু:শ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঘরে বাইরে, অফিস আদালত এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। হাঁটার পথে মোবাইলে একজনের গভীর মনোযোগ নিজের পাশাপাশি অন্যজনেরও সমস্যা সৃষ্টি করছে বা বিরক্তির কারণ হচ্ছে। যিনি হাঁটার পথে এয়ারফোন লাগিয়ে মোবাইলে কথা বলছেন, তিনি হয়তো খেয়ালই করছেন না তার পেছনের পথিকের কথা। সেই লোকটি হয়তো বিরক্তি বোধ করছেন। পথিক হয়তো আপনার মোবাইলের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে হাঁটছেন। কিন্তু মোবাইলে মনোযোগ থাকায় সেই বিষয়টি একবারও অনুভূত হচ্ছেনা। এতে অনেক সময় বিরূপ মন্তব্য করেন কেউ কেউ। 

বিষয়টি আমাদের প্রাত্যহিত জীবনে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. জায়েদা শারমিন স্বাতী। একারণে মৃত্যুও ঘটছে। তিনি বলেন, তরুণ তরুণীরা যখন এয়ারফোন ব্যবহার করে কথা বলে চলতে থাকে, তখন তার পেছন গাড়ি হর্ণ বাজালেও শুনতে পায় না। এমনকি শ্রেণিকক্ষেও তাদের মোবাইল খোলা থাকে। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে আলাদাভাবে ক্যাম্পেইন চালানো দরকার হয়ে পড়েছে। অবশ্য পরিবার থেকে সেটি শুরু করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে।

বিশিষ্ট গবেষক ড. সাদিকুর রহমান জানান, সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের সঙ্গে যোগ হয়েছে তরুণ তরুণীদের মোবাইলে কথা বলার প্রবণতা। কারণ তারা কথা বলার সময় এক পর্যায়ে সিরিয়াস হয়ে যান। তখন অন্যমনস্ক হয়ে মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, মোবাইলে কথা বলে বিপজ্জনকভাবে রেললাইনের ওপর দিয়েও যেতে দেখা যায়। আর এভাবে আমাদের দেশে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা।
বিশিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তা এ কে এম আতাউল করিম এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে এই দৃশ্য চোখে পড়ে না। এটি নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়, নিজেকেই সচেতন হতে হবে। তবে আইসিটি মন্ত্রণালয় যদি মানুষকে সচেতনতার জন্য মোবাইল ব্যবহারে কিছু উদ্যোগ নেয়, তাহলে হয়তো মানুষ গুরুত্ব দিবে। তিনি বলেন, মোবাইল কোম্পানীগুলোও এব্যাপারে সচেতনতা বিষয়ক ম্যাসেজ দিতে পারে। যেভাবে করোনার সময় তারা ম্যাসেজ দিয়েছিলো।  

নগরীর জিন্দাবাজার এলাকার একজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, এখন ফুটপাত দিয়ে চলার সময় প্রায় সময় এই দৃশ্যগুলো চোখে পড়ে। রাজা ম্যানশনের সুমন নামের একজন ব্যবসায়ী জানান, তাদের মার্কেটের সম্মুখের ফুটপাত উঁচু-নিচু। প্রায় সময় মোবাইলে কথা বলতে গিয়ে তরুণ-তরুণীরা হোঁচট খেয়ে পড়ছেন আর আহত হচ্ছেন। 

এমসি কলেজের শিক্ষার্থী  ফাতেমা জান্নাত বলেন, মোবাইলে কথা বলতে বলতে গাড়ির নিচে, ট্রেনের নিচে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। যারা মরছেন. তাদের মধ্যে তরুণরাই বেশী।  

বিশিষ্ট আইনজীবী, সিলেট স্টেশনক্লাবের সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, বিষয়টি সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে গণউৎপাতের পর্যায়ে চলে যায়। তিনি বলেন, হেডফোনে কথা বলা কিংবা গান শোনার সময় পেছন থেকে হর্ণ দিলেও শোনা যায়না। তখন একজনের কারণে বড় দুর্ঘটনায় অনেকজনের ক্ষতি হতে পারে। আবার চালকদের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের পরিবহন আইনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে একজন চালকের জরিমানার পাশাপাশি লাইসেন্স বাতিলও হতে পারে।