ছাত্রদল নিয়ন্ত্রণে ফের তৎপর ‘সিন্ডিকেট’

ছাত্রদল নিয়ন্ত্রণে ফের তৎপর ‘সিন্ডিকেট’


কেন্দ্রীয় নেতাদের পদ স্থগিত নিয়ে অসন্তোষ, নানা প্রশ্ন
রয়েল ভিউ ডেস্ক:
বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসাবে খ্যাত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিয়ন্ত্রণে ফের তৎপর হয়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। ছাত্রদলেরই সাবেক নেতাদের নিয়ে গড়া এ চক্রের সদস্যরা বর্তমানে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। বছরের পর বছর তারা পকেট কমিটি করে নিজেদের কব্জায় রেখেছিলেন দলের তারুণ্যের এ শক্তিকে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত নেন ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সর্বশেষ দুটি কমিটিতে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। যাতে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় সে সুযোগ করে দেন তিনি। এতেই ঘুম হারাম হয়ে গেছে সিন্ডিকেটের। তাই এখন নানা চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন তারা। বর্তমান কমিটিকে ‘ব্যর্থ’ করার লক্ষ্যে সব ধরনের কর্মকাণ্ডও করে যাচ্ছেন। এমন অভিযোগ দায়িত্বশীল অনেকের।

এদিকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে ইতোমধ্যে ছাত্রদলের কমিটিতে এক ধরনের সুনামি বয়ে গেছে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সর্বোচ্চ পারফরম্যান্স দেখানোর পরও তাদের ৩২ জনের পদ স্থগিত করা হয়েছে। এ রকম সিদ্ধান্ত ছাত্রদলের সাধারণ নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি বিএনপির কেন্দ্রীয় অনেক নেতাও চরম ক্ষুব্ধ। তবে দলের মধ্যে চাপে পড়ার আশঙ্কায় তারা যুগান্তর’র কাছে নাম প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি।

সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল।

সূত্র জানায়, বহু বছর ধরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিকে ‘পকেট কমিটি’ করে রেখেছিল বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে প্রতিটি কমিটি নিয়ে কম-বেশি বিতর্ক ছিল। অভিযোগ ছিল, এসব চক্রের কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে কমিটিতে নাম লেখাতে পারেননি। কেউ কেউ পেলেও প্রত্যাশিত পদ থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু তারেক রহমানের হস্তক্ষেপে ২০১৮ সাল থেকে ছাত্রদল সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি লাভ করে। এর ফলে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গোপন ভোটে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, যা ছিল সিন্ডিকেট মুক্ত প্রথম কমিটি।

এরপর ১৭ এপ্রিল কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘সুপার ফাইভ’ কমিটি দেওয়া হয়। এ কমিটিও ছিল সিন্ডিকেট মুক্ত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে জানান, শুধু ছাত্রদল নয়, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট জড়িত থাকে। এর কারণ, এসব সংগঠন হাতে থাকলে নির্বাচনি এলাকাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শাখায় পছন্দ অনুযায়ী তারা কমিটি গঠন করতে পারেন। এমনকি সাবেক অনেক এমপি আছেন, যারা তার নির্বাচনি এলাকায় দল থেকে আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দেখতে চান না। এমপি মনোনয়নকে পরিবারের মধ্যে ধরে রাখতে চান। এজন্য ছাত্রদলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বী ঠেকানোর ফর্মুলা হিসাবে কমিটি গঠনের সময় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন।

ছাত্রদলের ‘সুপার ফাইভ’ কেন্দ্রীয় কমিটি দেওয়ার পর ১১ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এর ৪ দিন পর বৃহস্পতিবার বিবাহিতসহ নানা অভিযোগে ৩২ কেন্দ্রীয় নেতার পদ স্থগিত করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমিটি ঘোষণার পর থেকে সুপার ফাইভে থাকা এক নেতা কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হন। ছাত্রদলের সাবেক এক সভাপতির নেতৃত্বে ছাত্রনেতাদের গড়া একটি সিন্ডিকেট ওই নেতাকে সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক করতে নানা মাধ্যমে চেষ্টা চালান। কিন্তু তারেক রহমানের শক্ত অবস্থানের কারণে তা ব্যর্থ হয়। ওই নেতার ক্ষুব্ধতাকে পুঁজি করে সংগঠনের ভেতরেই একটি গ্রুপ সৃষ্টি করেছে ওই সিন্ডিকেট। তাদের ইশারায় শ্রাবণ-জুয়েল কমিটিকে ব্যর্থ করতে নানা তৎপরতা চলছে। যাতে বর্তমান কমিটি দ্রুত সময়ের মধ্যে ভেঙে দিয়ে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরই অংশ হিসাবে প্রথমে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিট কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে সংগঠনটির শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ দেওয়া হয়। সেখানে মূল অভিযোগ ছিল, কমিটি গঠনে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলার নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কথাও বলেন শ্রাবণ ও জুয়েলের সঙ্গে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিট কমিটির শীর্ষ নেতারা শ্রাবণ-জুয়েলের অনুসারী নন। ত্যাগী ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই ওইসব কমিটি করা হয়।

সূত্র জানায়, ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার আগেও একটি অভিযোগ বাক্স খোলা হয়। তখন ওই বাক্সে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়, তাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে রাখা হয়নি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার ২ দিন পর ২৯ নেতার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয় পদবঞ্চিত একটি গ্রুপ। এছাড়াও তারা নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভও করেন। এই অবস্থায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তার নিজস্ব উইং দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এর পেছনে দলের বিভিন্ন সিন্ডিকেট ছাড়াও সরকারের একটি সংস্থা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। বিষয়টি সামনের দিকে বাড়তে না দিয়ে অভিযোগ উত্থাপন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২৯ নেতাসহ ৩২ জনের পদ স্থগিত করে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।

পদ স্থগিত হওয়া একাধিক নেতা আক্ষেপ করে যুগান্তরকে জানান, ‘আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক (তারেক রহমান) একবার যদি জানতে চাইতেন, আমরা বিবাহিত কিনা বা আমাদের বয়সসীমা পার হয়েছে কিনা তাহলে তাকে বলতে পারতাম। গণমাধ্যমে খবর হওয়ার পর পরিবার থেকে ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছে, কবে বিয়ে করেছি, কাকে বিয়ে করেছি। কিন্তু কোনো জবাব দিতে পারছি না। না পারছি ছাত্রদল করতে, না পারছি পরিবারের জবাব দিতে। তাছাড়া পরিবার এখন সব খরচ বন্ধ করে দেওয়ার কথাও বলছে।’

পদ স্থগিত হওয়া ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক জিয়ন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, আমার বিরুদ্ধে যে বিবাহের অভিযোগ করা হয়েছে তা যদি প্রমাণ দিতে পারেন তাহলে যে কোনো শাস্তি মেনে নেব। কিন্তু শুধু একটি অভিযোগের ভিত্তিতে আমার যে সুনাম ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, তা কি ফেরত পাব? ধরলাম এটা যদি প্রমাণ করতে না পারে, আমার পদ হয়তো ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু সামাজিকভাবে বা আমার পরিবারের কাছে যে ছোট হলাম তা তো ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই’। সহসভাপতি কাজী মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘অভিযোগ আসতেই পারে। সেটা যাচাই-বাছাই করে কিংবা তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে কিংবা প্রমাণ সহকারে তাদের পদ স্থগিত রাখলে তাদের কোনো কষ্ট হতো না।’-যুগান্তর