০ রয়েছে তদারকির অভাব ০ যথাসময়ে বিলের টাকা দেয়া হয়নি

দুর্বল বাঁধ ভেঙে ডুবছে হাওর

দুর্বল বাঁধ ভেঙে ডুবছে হাওর

কাউসার চৌধুরী
সুনামগঞ্জ জেলায় হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে শত কোটি টাকার অধিক অর্থ ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও এর যথাযথ তদারকি করেনি মর্মে অভিযোগ রয়েছে- পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এর বিরুদ্ধে। নীতিমালায় নির্ধারিত সময়ে শুরু করা হয়নি বাঁধের কাজও। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসিকে সময়মতো অর্থও দেয়া হয়নি। শুরুতে ঢিলেঢালা ভাবে কাজ চললেও শেষ পর্যায়ে দ্রুত শতভাগ কাজ সম্পন্ন করার তাগিদে কর্মকর্তারা ছিলেন তৎপর। ফলে অনেক বাঁধে তুলনামূলক দুর্বল কাজ হয়েছে। আর এই দুর্বল বাঁধ ভেঙেই একের পর এক হাওর ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ গত বুধবার দিবাগত রাতে জেলার অন্যতম বড় হাওর দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের ইরি-বোরো ফসল তলিয়ে যায়। স্থানীয় কৃষক, হাওর আন্দোলনের নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কথায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ জহুরুল ইসলাম বাঁধের কাজ দুর্বল হয়েছে বলে মানতে নারাজ।
তিনি বলেন, পাউবো-প্রশাসনের যৌথ তদারকিতেই কাজ হয়েছে। ‘বাঁধের কাজ নীতিমালা অনুযায়ী হয়ে থাকে। আমাদের সঙ্গে প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষও কাজ তদারকি করেন। কোথাও কোনো অনিয়মের খবর পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। হাওরের পরিবেশ-প্রকৃতি আলাদা। এখানে ইচ্ছে করলেই সবকিছু সময় বেঁধে করা যায় না। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাঁধ নির্মাণের মতো একটি বিশাল কাজ কম সময়ের মধ্যেই হয়ে থাকে। এতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে।

জানা গেছে, বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে দিরাই উপজেলার বৈশাখী বাঁধ ভেঙে চাপতির হাওর তলিয়ে যায়। উপজেলার তাড়ল, জগদল ও করিমপুর ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের লক্ষাধিক কৃষক এই হাওরে ইরি-বোরো চাষাবাদ করেন। কালনী নদীর পানির উচ্চতা থেকে বৈশাখী বাঁধ অন্তত ৩ ফুট উঁচু থাকার পরেও বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, সঠিক সময়ে বাঁধের কাজ শুরু করা হয়নি। শেষ সময় এসে তাড়াহুড়া করে কাজ করায় বাঁধটি তুলনামূলক দুর্বল ছিল। ফলে পানির ধাক্কা সামলাতে পারেনি। বৈশাখী বাঁধ ও এর আশপাশ এলাকার মাঠও শক্ত নয়। অনেকটা বালি মিশ্রিত হওয়ায় প্রায় বছরই বৈশাখী বাঁধ ভেঙে গিয়ে পুরো চাপতির হাওর তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
শাল্লা উপজেলার ভরাম হাওরের মৌরাপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী ২৩নং পিআইসির বাঁধের অবস্থাও ভালো নয়। দুর্বল কাজ করায় বাঁধটি ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো অঘটনের আশংকা করছেন স্থানীয় কৃষকরা। তবে, বাঁধটি রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে বিপুল সংখ্যক মানুষ দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন।
গত বুধবার দিনের বেলায় টাংনির হাওরের জারলিয়া বাঁধটিও ভেঙে যায় অনেকটা দুর্বল থাকায়। টানা ২৪ ঘণ্টার প্রাণপণ লড়াইর পর বাঁধে পানি প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান মামুন, স্থানীয় কুলঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একরার হোসেন, পাউবোর এসও মুনায়েমসহ প্রশাসনের কর্মকর্তা সেখানে পুরো রাত অবস্থান করে কাজের তদারকি করেন। জারলিয়া বাঁধ রক্ষার ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে।
এর আগে গেল মঙ্গলবার বিকেলে জেলার অন্যতম বড় হাওর ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনারথাল হাওরের ডোবাইল বাঁধটি ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। ডোবাইল বাঁধটিও অনেকটা দুর্বলভাবে নির্মাণ করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। বাঁধ ভেঙে হাওরের প্রায় ৩০ হাজার একর জমির আধা পাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরুর কথা থাকলেও এর অনেক দেরিতে পিআইসি গঠন করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ সম্পন্নের যেখানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, এই ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে অনেক পিআইসি গঠন করা হয়েছে। আবার পিআইসি গঠনের পর রাজনৈতিক নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপে পাউবোর ওয়েবসাইটে দেয়া কমিটিও পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। পিআইসিকে কাজের চলমান বিল দিতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয়া হয়। জরুরি এই কাজের অর্থ ছাড় দেয়া হয় ২৯ দিন পরে। সময়মতো টাকা না দেয়ায় অনেক বাঁধের কাজও পিছিয়ে পড়ে যায়।
আবার পিআইসি গঠনের শুরুতে শুরু হয় টাকার খেলা। ক্ষমতাসীন নেতারা নগদ টাকার বিনিময়ে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে দিয়ে গঠন করেন পিআইসি। টাকার বিনিময়ে অন্যদলের লোকজনকেও পিআইসি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। নেতাদের হস্তক্ষেপে প্রশাসন ও পাউবোর কর্মকর্তারা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েন। আবার কোনো কোনো উপজেলায় পাউবোর কর্মকর্তারা সরাসরি টাকার বিনিময়ে পিআইসি গঠন করেন। বাঁধের নামে টাকা হাতিয়ে নিতে একেবারে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ বছর শাল্লা উপজেলায় এমন একাধিক ঘটনা ঘটলেও এখনো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
পাউবোর তথ্য মতে, গেল ১৫ ডিসেম্বর জেলার ১১টি উপজেলায় মাত্র ১৮টি প্রকল্পে বাঁধের কাজ শুরু হয়। ওইদিন ২৪৭টি প্রকল্প অনুমোদন করে পাউবো। এর এক মাস পর ১৫ জানুয়ারি অনুমোদিত প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০১ এবং এর মধ্যে কাজ চলছিল ১৮৩টি প্রকল্পে। তখনো ৫০১টি প্রকল্পে কোনো কাজই শুরু হয়নি। গঠিত হয়নি ৩৩ পিআইসি। এরপর ৩০ জানুয়ারি পাউবো জানিয়েছিল, তাদের প্রকল্প বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২০টি এবং ৬০২টি প্রকল্পে কাজ চলছে। তখনো ১১৮টি প্রকল্পের কোনো কাজ শুরুই হয়নি। অথচ কাজের সময় ছিল মাত্র ২৮ দিন। তখনো কোনো উপজেলাতেই কাজের অগ্রগতি ৫০ শতাংশের বেশি ছিল না। সর্বনিম্ন ছিল শাল্লায় ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ছিল সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ৪১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যে উপজেলায় ৪৭ দিনে কাজের অগ্রগতি ছিল মাত্র ৭ শতাংশ, সেখানে বাকি ২৮ দিনে কাজের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ শতাংশ। যে উপজেলার অগ্রগতি ছিল ৫ শতাংশ, তার অগ্রগতি দাড়ায় ৯৬ শতাংশের ওপরে। মূলত শেষ দিকে কাজের শতভাগ সম্পন্ন দেখাতে জেলার সব হাওরে পিআইসিদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছিল। হুড়োহুড়ি করে কাজ সম্পন্নের কারনে অনেক বাঁধে কাজের মান নিশ্চিত করতে পারেনি পাউবো।
পাউবোর দেয়া তথ্য মতে, চলতি অর্থ বছরে জেলার বৃহৎ ৩৬ টিসহ মোট ১৫৪টি হাওরের ফসল রক্ষায় চলতি অর্থ বছরে ৫২০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করছে। ৭২২টি পিআইসির মাধ্যমে জেলার ১১টি উপজেলায় বাঁধের কাজ শুরু হয়। এজন্যে বরাদ্দ চাওয়া হয় ১২২ কোটি টাকা। পিআইসির মধ্যে রয়েছে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ২৬টি, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ৩৩টি, ধর্মপাশা উপজেলায় ১৫৭টি, তাহিরপুর উপজেলায় ৬৮টি, জামালগঞ্জ উপজেলায় ৪০টি, শান্তিগঞ্জ উপজেলায় প্রকল্প ৫৬টি, দিরাই উপজেলায় প্রকল্প ১০৪টি, শাল্লা উপজেলায় প্রকল্প আছে ১৩৮টি, জগন্নাথপুর উপজেলায় প্রকল্প ২৮টি, দোয়ারাবাজার উপজেলায় প্রকল্প ৫০টি, ছাতক উপজেলায় ২২টি পিআইসি বাঁধ নির্মাণ, পুনঃ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করে। সুনামগঞ্জ জেলায় হাওর রক্ষা বাঁধ বা ডুবন্ত বেড়ি বাঁধের মোট পরিমাণ ১ হাজার ৬৮০ কিলোমিটার।
কৃষি বিভাগ বলছে, সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে চলতি মৌসুমে ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের চাষাবাদ করা হয়েছে। চাষ হওয়া জমি থেকে ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকার ইরি-বোরো ধান উৎপাদনের কথা ছিল।