দৃষ্টি প্রতিবন্ধী উচ্চ শিক্ষিত এক আফসানার জীবনের গল্প

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী উচ্চ শিক্ষিত এক আফসানার জীবনের গল্প

আহমাদ সেলিম.
জন্ম থেকে দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী আফসানা হোসেইন। তবু থেমে নেই তার এগিয়ে যাবার স্বপ্ন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে অস্থায়ীভাবে শিক্ষকতা করছেন সমাজসেবা পরিচালিত সমন্বিত দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী কার্যক্রম সিলেটের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তিনি সুযোগ পেলে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য বড় পরিসরে কাজ করার স্বপ্ন দেখছেন। শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমরা আফসানাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তার মতো অন্যদের প্রতিও যত্নশীল এবং আন্তরিক। তাদের উন্নত জীবনের পাশে আমাদের সহযোগিতা থাকবে সবসময়।

সিলেটে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করেন, সেই মানুষদের কাছে সুপরিচিত একটি নাম আফসানা হোসেইন। কারো কাছে তিনি ‘আফসানআপা’ কারো কাছে ‘আফসানা ম্যাডাম’। মানুষকে আপন করে নেন খুব সহজে। তিনি প্রতিবন্ধী শিশুদের ভালোবাসেন, কাছে টেনে নেন পরম স্নেহে। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি ভালো আবৃত্তিও করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আবৃত্তি সংগঠন মাভৈ পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

আফসানারা তিন বোন। শাহজালাল উপশহরে মা-বাবা বসবাস করলেও তিনি থাকেন নগরীর রায়নগর শিশু পরিবারে। অনাথ, সুবিধাবঞ্চিত এই আশ্রয়স্থলই তার ঠিকানা। এর পেছনে রয়েছে নিতান্ত এক মায়ার গল্প। সমন্বিত দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী কার্যক্রম পরিচালিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি পাইলট স্কুলের ভেতর থাকা সেই বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত সকল শিশুরা দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী। সেই শিশুরা ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ছে। পাঠদান শেষে তিনি চলে যান রায়নগর শিশু পরিবারে। সেখানেও খুব অল্পসময়ে তিনি সবার পছন্দের তালিকায় যুক্ত হয়ে যান। আবাসিকে থাকা এতিম অসহায় শিশুরা তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, তার কাছে লেখাপড়া করছে। সেই শিশুদের মায়াজালে জড়িয়ে তিনি নিজের বাসাকেও ভুলে থাকছেন।

দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী হবার পরও আফসানার এগিয়ে চলা আমাদের সমাজের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তার এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় অনুপ্রেরণা ছিলো পরিবার। তারা সব সময় তাকে সাহস জুড়িয়েছেন। ফলে তার আত্মবিশ্বাস ছোটবেলা থেকেই আরো প্রবল হয়ে উঠে। তবে শুধু আফসানা নয়, সুস্থ স্বাভাবিক অন্য দুবোনও উচ্চ শিক্ষায় সুনাম কুঁড়িয়েছেন। বড় বোন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা শেষ করে বর্তমানে সিলেটের একটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন এবং সবার ছোট বোন পড়ছেন, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে। বাবা মো. আবুল হোসেইন ছিলেন, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং মা রওশন আরা সুলতানা শিক্ষক। ছাতক সারকারখানা স্কুলে শিক্ষকতা করলেও বর্তমানে তিনি সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আশুগঞ্জ সার কারখানা স্কুলে।

আফসানা হোসেইন শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০১৫ সালে অনার্স এবং ২০১৬ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। শুধু উত্তীর্ণ নয়, ভালো ফলাফলেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। একইভাবে মেধার পরিচয় দিয়েছেন, এস.এসসি এবং এইচ.এস.সি পরীক্ষায়। আফসানা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তাই ব্রেইল পদ্ধতিতেই তাকে লেখাপড়া করতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই পদ্ধতিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করে ২০১৯ সালে তিনি ঢাকার মিরপুরের জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র থেকে ব্যাচেলর অব স্পেশাল এডুকেশন (বি.এস.এড) ডিগ্রি লাভ করেন।

আফসানার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা জানান, দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী হলেও অনেক ক্ষেত্রে সে আমাদের থেকে এগিয়ে রয়েছে। সে প্রচন্ড মেধাবী। কারো সাহায্য ছাড়া সে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলাফেরা করতো। ঘরের রান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করতো একা। অনেক সময় আমরা দৃষ্টিসম্পন্ন হয়েও যা করতে পারিনি, সে তাও করে ফেলতো।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ে আফসানার ইচ্ছে ছিলো সেখানেই যদি একটি চাকরীর সুযোগ হয়। তবে তার জন্য মঙ্গল হতো। অনেক দিনের চেনাজানা এবং পরিচিত প্রতিষ্ঠানে খুব সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু সেই সুযোগ আসেনি। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। এরই মধ্যে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে অস্থায়ীভাবে যোগ দেন সমাজসেবার সমন্বিত দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী কার্যক্রম পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আর চাকুরীর এই সুযোগটি তৈরী হয় সিলেট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক নিবাস রঞ্জন দাশ এর কল্যাণে।

আফসানা জানান, ‘আমি কখনো নিজেকে দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী ভাবিনা। আমি জীবন চলার পথে সবার সহযোগীতা পাচ্ছি। আগামীতেও সবার সহযোগিতা চাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি চাই আমার মতো সবাই এগিয়ে আসুক, দেশের জন্য কিছু করুক।’

আফসানার বড় বোন শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুল এন্ড কলেজের আইসিটি বিভাগের প্রভাষক দিল আফরোজা জানান, ‘আমার বোনটি প্রচন্ড আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী। যে বিশ্বাস নিয়ে পথ চলছে, সে পথে দরকার সহযোগিতা। শুধু সহযোগিতা পেলে সে দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে অনেক কিছু করতে পারবে। সেই সক্ষমতা তার মধ্যে রয়েছে।’

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুরাদ জানান, ‘আফসানা খুবই মেধাবী ছিলো। পড়াশোনায় তার মনোযোগ দেখে কখনো বুঝতে পারিনি সে দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী। তার মধ্যে সবসময় অজানাকে জানার কৌতুহল কাজ করতো। তিনি বলেন, আফসানার মতো অভাবনীয় মেধাবী ছাত্রী বর্তমানে অস্থায়ীভাবে একটি চাকরী করছে শুনে খুশি হয়েছি। তবে সুযোগ পেলে সে আরো উচু পর্যায়ে যাবার যোগ্যতা রাখে।’

সিলেট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক নিবাস রঞ্জন দাশ এর সাথে এ প্রসঙ্গে কথা হলে তিনিও একবাক্যে আফসানার বিশেষ মেধার প্রশংসা করে বলেন, ‘আফসানার বাহ্যিক দৃষ্টি না থাকলেও তার অন্তর দৃষ্টি প্রখর। সে ২০২০ সাল থেকে সমাজসেবার সমন্বিত দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী কার্যক্রম পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরী করছে। তিনি বলেন, আমরা তাকে নিয়ে ভাবছি। তার ভালো কিছু হলে আমি নিজেও আনন্দিত হবো।’ শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীর প্রতি আমি আন্তরিক। আফসানার চাকরীর বিষয়টিও আমি দেখবো।’