নগরীর সবচেয়ে বড় লালাদিঘী আকৃষ্ট করছে পর্যটকদের

নগরীর সবচেয়ে বড় লালাদিঘী আকৃষ্ট করছে পর্যটকদের

আহমাদ সেলিম
সিলেট মহানগরীর বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ শিশু-কিশোর সাঁতার জানে না। শুধু শিশু-কিশোর নয়, সাঁতার জানেন না বিপুল সংখ্যক তরুণ-যুবকরাও। অথচ এক সময় নগরীর প্রায় শতভাগ নারী-পুরুষ শুধু সাঁতার জানতেন না, সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশও নিতেন অনেকে। বাড়ি বাড়ি পুকুর আর স্থানে স্থানে দিঘী থাকার কল্যাণে সেটি সম্ভব হতো। কিন্তু সেই পুকুরের সুদিন এখন আর নেই। দিঘীগুলোও বিলীন হওয়ার পথে । তবে, বর্তমানে পুকুর আর দিঘীর আকালে নগরীর ভেতর সবচেয়ে বড় দিঘীর মর্যাদায় সমুন্নত রয়েছে লালাদিঘী। ১৩ ‘কিয়ার’ সীমানা নিয়ে দিঘীটি পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করছে। ১১ নম্বর ওয়ার্ডে এই দিঘীর অবস্থান।
নিকট অতীতে শহরের বাসা-বাড়ির ঐতিহ্য ছিলো পুকুর। প্রতিটি বাসায় পুকুর থাকাটা একটা আভিজাত্যের অংশ ছিলো। কোনো কোনো বাড়িতে একাধিক পুকুর ছিলো। পুকুর থাকার ফলে অল্প বয়সেই শিশুরা সাঁতার শিখে ফেলতো সহজে। সাঁতার ছাড়াও বাসার প্রাত্যাহিক সবকাজে পুকুর, দিঘী ছিলো নিত্যসঙ্গী। পুকুর থাকায় বাড়ি বাড়িতে মাছেরও অভাব ছিলোনা। আত্মীয় স্বজন, বিশেষ করে বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসলে জাল ফেলে তাৎক্ষণিক মাছ ধরা হতো। কেউ বড়শী নিয়েও মাছ শিকার করতেন। কিন্তু সেই চিত্র এখন রূপকথার মতো মনে হয়। সেই বাস্তবতায় লালাদিঘীটি নগরে বসবাসকারী এ প্রজন্মের শিশুদের কাছে অবাক বিস্ময়ের মতো হয়ে আছে। অনেকে তাদের সন্তানদের নিয়ে লালাদিঘী দেখতে যান। বিকেলবেলা দিঘীর সামনে দাঁড়িয়ে সময় পার করেন। শহরের ভেতর দীর্ঘতম দিঘীটি শিশুদের নির্মল আনন্দ দেয়। তবে ঋতু পরিবর্তনের সাথে দিঘীটিও তার লাবণ্য মেলে ধরে। বর্তমানে শীত মৌসুমে ভোরবেলা লালাদিঘী ভরে ওঠে ঘনকুশায়ায়। সাদা চাদরের মতো কুয়াশা অন্যরকম আবহ তৈরী করে চারপাশে। আর বৃষ্টির সময় দিঘী ভরে যায় আরেক স্নিগ্ধতায়। তখন অনেকে দিঘীর জলে নৌকা ভাসান।
সিটি কর্পোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডে অন্তত তিন হাজার পরিবারের বসবাস। গতকাল রোববার সকালে সরেজমিন লালাদিঘীরপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, দিঘীকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকা মনোরম হয়ে উঠেছে। চারপাশে রয়েছে সুন্দর গার্ডওয়াল। একপাড় থেকে আরেকপাড়ে যেতে অন্তত দুই থেকে তিন মিনিট সময় ব্যয় হচ্ছে। দিঘীর আশপাশে যাদের সাথেই কথা বলেছি, তারা সৌন্দর্য রক্ষার তাগিদ দিয়েছেন।
স্থানীয় সিটি কাউন্সিলর রকিবুল ইসলাম ঝলক জানান, ‘একসময় এই দিঘী আমাদের ঐতিহ্য ছিলো। এখন সেটি পুরো সিলেটবাসীর ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। কারণ, এর চেয়ে বড় কোনো দিঘী এখন সিলেটে নেই। তিনি আরো জানান, একসময় শহরের অধিকাংশ এলাকায় এমন দিঘী ছিলো, পুকুর ছিলো। অনেক বাড়িতে ছিলো একাধিক পুকুর। ব্যক্তি মালিকানাধীন সেই পুকুর, দিঘী এখন ভরাট হয়ে গেছে। কাউন্সিলর বলেন, লালাদিঘীর নামে আমাদের পাড়ারও নামকরণ হয়েছে। তাই এ দিঘীর সাথে প্রতিটি মানুষের আবেগ, অনুভূতি জড়িয়ে আছে। আমরা সেই এতিহ্য ধরে রাখতে সবার সহযোগিতা চাই।
লালাদিঘীরপাড় এলাকার বাসিন্দা বিশিষ্ট কবি এ কে শেরাম এর সাথে এ প্রসঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ‘এই দিঘী সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর দিঘী। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কোনো রাজা-বাদশা নয়, অনেকেই দিঘী দেখতে আমাদের পাড়ায় আসেন। বিশেষ করে পাশে মণিপুরীপাড়া থাকায় বিদেশে থেকেও পর্যটকরা আসেন। দিঘীটি দেখে তারা অভিভূত হন। তবে সিটি কর্পোরেশন পরিবেশের স্বার্থে কিছু উদ্যোগ নিলে এটি আরো আকর্ষণীয় হতে পারে। এতে শুধু লালাদিঘী নয়, সিলেটের সুনাম বৃদ্ধি পাবে।’
এলাকার বাসিন্দা পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তানের আহবায়ক আশরাফুল কবীর জানান, ‘পুকুর না থাকায় শহরের অধিকাংশ মানুষ সাঁতার শিখা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। সিটি কর্পোরেশন উদ্যোগ নিলে সাঁতার শিখার জন্য লালাদিঘীকে কাজে লাগাতে পারে। তিনি বলেন, দিঘীটি যাতে দূষণ না হয়, বিলুপ্ত না হয় তার জন্য সবাইকে স্বার্থের উর্ধ্বে কাজ করতে হবে।’
বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম জানান, পরিবেশের স্বার্থে, সিলেটৈর স্বার্থে লালাদিঘীকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দরকার। কারণ এটি এখন সিলেটের সম্পদ। তিনি বলেন, বিগত বিশ বছরে শুধু সিলেট নগরীর ভেতর অন্তত অর্ধশতাধিক পুকুর-দিঘী ভরাট করা হয়েছে। ভরাট হয়ে যাওয়া সেই পুকুর দিঘী ছিলো ব্যক্তি মালিকানাধীন। তিনি বলেন, সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশন বর্ধিত হয়েছে। সেই বর্ধিত অংশের মধ্যে অন্তত ২০০টি পুকুর রয়েছে। সেগুলোর কি হবে? কারণ নতুন এলাকাগুলো সিটি কর্পোরেশনের সাথে অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় ভূমির দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই বাস্তবতায় আমরা কতটা পুকুর বাঁচাতে পারবো জানিনা। তবে সিটি কর্পোরেশর জোরালো ভূমিকা রাখলে সেটি সম্ভব হতে পারে।’
কথা হলে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানান, দিঘীটি আধুনিকায়নে আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি। পর্যটকদের যেভাবে আকৃষ্ট করা যায়, সেভাবেই আমরা দিঘীকে সাজাবো। একইভাবে সাঁতার শেখার একটা ব্যবস্থা রাখা যায় কি না তারও পরিকল্পনা রয়েছে।