নান্দনিক রূপে ফিরছে ধোপাদিঘী

নান্দনিক রূপে ফিরছে ধোপাদিঘী

 নূর আহমদ
দখল-দূষণে অস্তিত্ব সঙ্কটে থাকা নগরীর ধোপাদিঘী এবার নান্দনিক রূপে ফিরছে। দিঘীর তত্বাবধানে থাকা সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক)-ই দিঘীটি রক্ষা ও সৌন্দর্যবর্ধন করে সাধারণের জন্য খুলে দিচ্ছে। মূল দিঘীর আয়তন সংকুচিত করে ইট-পাথর-সিমেন্টের ওয়াকওয়ে দৃষ্টিনন্দন হতে পারে; তবে প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশ অনুকূল নয়-এমন নানা অভিমত ছিলো পরিবেশবাদীদের। তবে, সবকিছু ছাপিয়ে ভারত সরকারের অর্থায়নে সৌন্দর্যবর্ধন কাজ শেষ করে উদ্বোধনের তারিখও নির্ধারণ করেছে সিসিক। আগামী ১১ জুন সিলেট এক আসনের সংসদ সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী ও সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী-এর আনুষ্ঠানিকভাবে ধোপাদিঘী ওয়াকওয়ের পাশাপাশি আরো তিনটি প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। বাকি দুটি প্রকল্প হচ্ছে- ৬ তলা বিশিষ্ট চারাদিঘীরপার স্কুল ও কাষ্টঘর সুইপার কলোনী উদ্বোধন হবে।

দিঘীর শহর হিসেবে পরিচিতি ছিলো সিলেটের। মজুমদার দিঘী, দস্তিদার বাড়ী দিঘী, রামেরদিঘী, লালদিঘী, ধোপাদিঘী, মাছুদিঘী, কাষ্টঘর দিঘী, সুপানিঘাট দিঘী, কাজলশাহ দিঘী, সাগরদিঘী, চারাদিঘীসহ অসংখ্য দিঘী ছিলো নগরজুড়ে। তবে এসব দিঘীর বেশিরভাগই দখল করে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। যেগুলো বেঁচে আছে তাও আবার রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে। তেমনি একটি ধোপাদিঘী। সেই নাম অনুসারে নগরীর একটি এলাকারই নামকরণ হয়েছে ধোপাদিঘীর পাড়। সিলেটের ধোপাদিঘীই একসময় পড়েছিলো অস্তিত্ব সংকটে। শিশু পার্ক, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি আর মাইক্রোবাসের স্ট্যান্ডের নামে বেশ কিছু জায়গা চলে যায় অন্যহাতে। যেটুকু অবশিষ্ট ছিলো সেগুলো উদ্ধার করে ধোপাদিঘীকে নতুন রূপ দেয়ার ঘোষণা দেয় সিসিক ।  ভারত সরকার এগিয়ে আসে এর অর্থায়নে। ‘ধোপাদিঘী এরিয়া ফর বেটার এনভায়মেন্ট এন্ড বিউটিফিকেশন' নামে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ডালি কনস্টাকশন নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে দিঘী উদ্ধারে উচ্ছেদে নামে সিসিক। সে সময় উচ্ছেদ করা হয় দিঘী দখল করে গড়ে ওঠা বেশকিছু স্থাপনা। চারদিকে স্থাপনার কারণে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ধোপাদিঘী ওই অভিযানের ফলে কিছুটা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বিষয়টি প্রশংসা কুঁড়ায় নগরবাসীর। এরপর চলতে থাকে সৌন্দর্য্য বর্ধন কাজ। মধ্যখানে পরিবেশবাদীরা মূল দিঘীর আয়তন সংকুচিত করে তোলার অভিযোগ করেন। তবে সিটি কর্পোরেশন দাবি করে ধোপাদীঘির আকার ছোট হবে না। বরং নোংরা দুর্গন্ধময় পরিত্যক্ত এই দীঘিকে অপরূপ সৌন্দর্য্যে দৃশ্যমান করে তোলা হবে।

সিসিক জানায়, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ধোপাদিঘীতে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। দীঘির চারদিকে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। বসার জন্য রয়েছে বেঞ্চ। পুকুরে নামার জন্য রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ঘাট। পুকুরের নোংরা পানিকে পরিষ্কার করা হবে। বৃক্ষপ্রেমীদের পরামর্শে সুদৃশ্যভাবে লাগানো হবে সবুজ বৃক্ষ। রয়েছে একাধিক টয়লেট। এসব টয়লেট ও বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার জন্য রয়েছে আলাদা পাইপলাইন। পুকুরের পানির সাথে পাইপলাইনের সংযোগ নেই। সবার জন্য উন্মুক্ত এই জায়গাটির প্রবেশপথ থাকবে সিটি কর্পোরেশনের মসজিদের উত্তর পাশ দিয়ে এবং মহানগরবাসী সকাল-বিকেল ও সন্ধ্যায় যাতে এখানে এসে হাঁটতে পারেন। সেজন্য রাতের বেলা আলোকসজ্জাসহ সংশ্লিষ্ট সকল সুবিধা রয়েছে দিঘীর চারদিকের ওয়াকওয়েতে। 
অপরদিকে, দিঘীর সৌন্দর্য বর্ধন কাজ শুরুর পর পরিবেশবাদীরা নানা অভিযোগ তুলেন। প্রকল্পের পরিকল্পনায় পুকুরের মধ্যখানে একটি রেস্তোরাঁ করার খবর চাউর ছিলো। তবে সিটি কর্পোরেশন সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। তবে আপাতত ওয়াকওয়ে আর মাঝে মাছে বসার জায়গা ছাড়া তেমন কোন অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। 

সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, এই দিঘীটি ছিল অব্যবহৃত। তাই দিঘীটির অস্তিত্ব রক্ষা ও সৌন্দর্য বর্ধন করে যেন শহরের মানুষের উপকারে আসে-সেজন্য সিটি কর্পোরেশন এই প্রকল্প হাতে নেয়। পরিবেশ ধবংস করা বা দিঘীকে ক্ষতি করা কখনো উদ্দেশ্য ছিলো না। তিনি বলেন, ভারত সরকার যে টাকা দিয়েছিলো, সেই টাকার ভেতরে যা যা হয়, তা করা হয়েছে। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে লাইটিং করে দেয়া হচ্ছে। দিঘীর মধ্যখানে রেস্তোরাঁ করা বা কোন অবকাঠামো করার পরিকল্পনা সিসিকের নেই। 

নূর আজিজুর রহমান জানান, ১১ জুন বেলা ১১টায় ধোপাদিঘী ওয়াকওয়ে উদ্বোধনের পাশাপাশি চারাদিঘীরপার স্কুল ও কাষ্টঘর সুইপার কলোনী উদ্বোধন হবে। এ তিন প্রকল্পে সবমিলিয়ে ব্যয় হয়েছে ২১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও ভারতীয় হাইকমিশনারের উপস্থিতিতে এ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হবে বলে জানান তিনি। 

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদুল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহীন বলেন, মূল দিঘীর আয়তন সংকুচিত করে ইট-পাথর-সিমেন্টের ওয়াকওয়ে দৃষ্টিনন্দন হতে পারে; তবে প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশ অনুকূল নয়। আমাদের দাবি হচ্ছে, ধোপাদিঘীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত শিশু পার্ক অপসারণ করতে হবে। তিনি বলেন,  বর্তমান যুগে গড়ে উঠা স্থাপনা সরিয়ে দিঘীকে পূর্বাকার অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া কঠিন কিছু নয়। সিটি কর্পোরেশন চালিয়ে সেটা সম্ভব। তিনি বলেন, কোন অবস্থায় যেন সেখানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠে; সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। দিঘীর পাড় যাতে পরিবেশ বান্ধব থাকে; সে দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। 

সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ধোপাদিঘী রক্ষা করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতেই মূলত সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। মূলত দিঘী খনন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, পাড় বাধানো ও ঘাট তৈরি তৈরি করা ছিলো-এ প্রকল্পের মূল কাজ। সেই কাজটিই করা হয়েছে। 
মেয়র বলেন, দীর্ঘদিন থেকে আমার একটি স্বপ্ন ছিল সিলেট মহানগরবাসীর হাঁটাচলার জন্য একটি নির্মল পরিবেশের স্থান গড়ে তোলা। যেখানে নগরবাসী কিছুটা সময় নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে উপভোগ করবেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ধোপাদীঘিকে কেন্দ্র করে এই রকম একটি আবহ তৈরি করা হয়েছে। আশা করি নগরবাসী উপকৃত হবেন।