পেশায় পুলিশ, নেশায় মাদক

পেশায় পুলিশ, নেশায় মাদক

ডোপ টেস্ট না হওয়ায় সিলেটে পুলিশ বিভাগে মাদকাসক্তি বাড়ছে

কাউসার চৌধুরী

‘কক্ষে কেউ নেই। টেবিলে রাখা মদের বোতল থেকে কাচের কাপে মদ ঢেলে পান করছেন একজন। পাশে রাখা কোকাকোলার বোতল। আছে মিনারেল ওয়াটার। সামনের প্লেটে রাখা মাংসসহ নানা পদের খাবার। টেবিলে বসে মদপান করে টালমাটাল অবস্থা লোকটির।’
এ রকম এক ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই লোকটির নাম মাসুদ আহমদ চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের কনস্টেবল। বর্তমানে সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) বেতার কেন্দ্রে কর্মরত। তার বিপি নম্বর-৯৩১২১৫১৭৮০। কেবল খাবারের টেবিলেই নয়, একটি কক্ষে ব্যায়াম করছেন মাসুদ, তার ঠিক পেছনের আরেকটি টেবিলে অন্যান্য জিনিসপত্রের সাথে মদের বোতলও দেখা গেছে।
আরেক ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, ঘরের মেঝেতে বসে আরেকজন ইয়াবার ধোঁয়া গ্রহণ করছেন। একের পর এক টান দিচ্ছেন হাতে থাকা কাটিতে। নেশায় মাতাল ওই লোকটিকে আরেকটি স্থিরচিত্রে এক নারীর সাথে নৃত্যে অংশ নিচ্ছেন। ইয়াবা গ্রহণকারী ওই লোকটির নাম নাদিরুজ্জামান চৌধুরী। তিনিও বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য। বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির হবিগঞ্জ অফিসে কনস্টেবল পদে কর্মরত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তার বিপি নম্বর ৮৭১২১৫১৭৮৯। পেশায় পুলিশ আর নেশায় মাদকসেবী মাসুদ আহমদ চৌধুরী বা নাদিরুজ্জামান চৌধুরীর মতো আরও অনেকেই রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

এক হিসেবে জানা গেছে, সিলেটে কর্মরত কনস্টেবল থেকে সিনিয়র অফিসার পর্যায়ের প্রায় শতাধিক পুলিশ সদস্য যারা নিজেকে নিষিদ্ধ মাদকে জড়িয়েছেন। মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কনস্টেবলদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কনস্টেবল ছাড়াও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই), উপ-পরিদর্শক (এসআই), পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তাও মাদকে জড়িয়ে পড়ছেন। এদের কেউ নিয়মিত মদ, আবার কেউবা গাঁজা, এমনকি কেউ কেউ নিয়মিত ইয়াবাও সেবন করেন। আবার কেউ বা অন্য জাতের মাদকও গ্রহণ করে থাকেন। সিলেটে ডোপ টেস্ট চালু না করায় মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।

পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে পুলিশে মাদকাসক্তি বৃদ্ধির এই তথ্য পাওয়া গেছে। মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যরা সিলেটের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত রয়েছেন। সিলেটের ডাক থেকে যোগাযোগ করা হলে মাসুদ এ নিয়ে কথা বলা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। 
নাদিরুজ্জামান প্রথমে ভিডিও-ছবি এডিট করা বলে দাবি করলেও শেষে জানান, তিনি আগে মদপান করলেও এখন করেন না। এখন যেহেতু মদের নেশা তার নেই, তাই রিপোর্ট না করারও অনুরোধ করেন নাদিরুজ্জামান।
ডোপ টেস্ট চালু না হওয়ায়-- 
জানা গেছে, করোনাকালে ২০২০ সালে নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশ কর্মকর্তা আকবর হোসেন ও তার সহযোগীদের হাতে আখালিয়ার যুবক রায়হান আহমদ হত্যাকান্ডের পর মহানগর পুলিশ ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে। ওই সময় একসময়ের সিলেটে দায়িত্বপালনকারী পুলিশ কর্মকর্তা নিশারুল আরিফকে এসএমপির কমিশনার পদে নিয়োগ দেয় পুলিশ সদর দপ্তর। তিনি সিলেটে এসেই নগর পুলিশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে নানান কার্যক্রম শুরু করেন। এরই মধ্যে ওই বছরের ১২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার নগর গোয়েন্দা পুলিশের এক সভায় এসএমপির কমিশনার নিশারুল আরিফ এসএমপিতে ডোপ টেস্ট শুরুর ঘোষণা দেন। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদকের সংশ্লিষ্টতা সন্দেহ হলেই তার ডোপ টেস্ট করা হবে। সন্দেহ হলে সিনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও ডোপ টেস্ট করার কথাও বলেন তিনি। খোদ নগর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তার এই ঘোষণায় নগর পুলিশ সদস্যরা নড়েচড়ে বসেন। মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।
ওই সময়ে কর্মরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ কমিশনারের এমন হুঁশিয়ারির পর নগর পুলিশের ছয়টি থানার দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করে সতর্ক করে দেন। থানার ওসিগণ প্রতিটি থানায় সচেতনতামূলক সভা করে কমিশনারের সতর্কবার্তা পৌঁছে দেন। কিছু মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যের প্রতি নজরদারিও করা হয় বলে সূত্র জানায়। ডোপ টেস্ট চালুর ঘোষণায় অনেক পুলিশ সদস্য মাদক ছেড়ে দিতে নানা চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ না হওয়ায় পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ তার বহুল কাক্সিক্ষত ওই উদ্যোগটি আর বাস্তবায়ন হয়নি।
এদিকে, ডোপ টেস্ট শুরু না হওয়ায় মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। আবার অনেকে নতুন করে মাদকে জড়িয়ে পড়েছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। মাদকাসক্তদের মাঝে এখন আর ডোপ টেস্টের কোনো ভয়-আতঙ্কও নেই বলে সূত্র জানিয়েছে।
কনস্টেবলদের মধ্যেই মাদকাসক্তি বেশি
দেশে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ পুলিশের মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ ডিএমপিতে ডোপ টেস্ট কার্যক্রম শুরু হয়। 
ডিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডোপ টেস্টে কনস্টেবলদের মধ্যেই বেশি পজিটিভ ধরা পড়ে। প্রথম পর্যায়ে ওই ডোপ টেস্টে মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়া ১২৬ পুলিশ সদস্যের মধ্যে ৯৮ জনই কনস্টেবল। বাকিদের মধ্যে একজন পুলিশ পরিদর্শক, ১১ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই), একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট, সাতজন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) এবং আটজন নায়েক।
মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য
হবিগঞ্জ সিআইডিতে কর্মরত কনস্টেবল শাহ মো. নাদিরুজ্জামান চৌধুরীর সাথে গতকাল বিকেলে এ প্রতিবেদকের কথা হয়।
তিনি বলেন, আগে সুনামগঞ্জ জেলায় সিআইডিতে পোস্টিং ছিল। মাস চারেক ধরে হবিগঞ্জ জেলা সিআইডিতে পোস্টিং হয়েছে। হবিগঞ্জ পোস্টিং হওয়ার আগে বিভিন্নজন তার বিরুদ্ধে মাদকের কথা রটিয়েছিল। এরপর ডোপ টেস্ট করেও মাদকাসক্ত বলে কোনো সম্পৃক্ততা মিলেনি। এগুলো উদ্দেশ্যমূলক। তার মাদক গ্রহণের ছবি ও ভিডিও নিয়ে প্রশ্ন করা হলে নাদিরের দাবি, ছবি ও ভিডিও সবই এডিটিং করে তৈরি করা হয়েছে। মূলত ষড়যন্ত্র করে তাকে ফাঁসানোর জন্য এসব করা হয়। এরপর তিনি এ প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত সেলফোনের নম্বর দিতে বারবার অনুরোধ করেন। এ প্রতিবেদক সিলেটের ডাক’র সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে তিনি সিলেটের ডাকর বার্তা কক্ষের টিএন্ডটিতে কল ব্যাক করেন। এ সময় নাদির বলেন, ভুলত্রুটি মানুষেরই হয়। অতীতে মাদক গ্রহণ করলেও এখন আর মাদক গ্রহণ করেন না। ভবিষ্যতে আর কোনো দিনও মাদক গ্রহণ করবেন না বলে এ বিষয়ে রিপোর্ট না করতে অনুরোধ জানান।
এসএমপিতে কর্মরত কনস্টেবল মাসুদ আহমদ চৌধুরীর সাথে মাদক গ্রহণের বিষয়ে কথা বলতে গত ১১ সেপ্টেম্বর বিকেল সোয়া ৪ টায় সিলেটের ডাক’র বার্তা কক্ষের টেলিফোন থেকে এ প্রতিবেদক কল দেন। মাসুদ চৌধুরী পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর পরই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত অসংখ্য বার কল দেয়া হলেও তিনি আর কল রিসিভ করেননি। এমনকি পরবর্তীতে কল ব্যাকও করেননি।
পুলিশ কমিশনার কী বলেন
ডোপ টেস্ট ও পুলিশ সদস্যদের মাদকাসক্তির বিষয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. ইলিয়াছ শরীফ পিপিএম (বার) এর সাথে এ প্রতিবেদক কথা বলেন। 
এসএমপি কমিশনার ডোপ টেস্ট প্রসঙ্গে বলেন, এটি সারা দেশেই চলমান রয়েছে। কারো প্রতি সন্দেহ হলে তখনই এই (ডোপ টেস্ট) কার্যক্রম চালানো হয়। এটা পাবলিকলি ঘটা করে করার বিষয় নয়। এটা অভ্যন্তরীণ বিষয়। যে মাদকাসক্ত, মাদক গ্রহণ করছে এমন অভিযোগ তো থাকতে হবে। অভিযোগ না থাকলে তো কাউকে ধরে এনে টেস্ট করা যায় না। যেকোনো ভাবে যদি জানা যায়, সে মাদকাসক্ত, অনেক সময় পরিবার বা সহকর্মীরা অভিযোগ করে -তখন অবশ্যই ডোপ টেস্ট করা হয়।
এ বিষয়ে সিআইডি হবিগঞ্জ জেলার ইনচার্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমেনা আক্তারের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। গতকাল বিকেলে ফোন করলে তার সেল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
শুদ্ধি অভিযানের পরামর্শ
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সিলেটের সাবেক পিপি এডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন পুলিশ সদস্যদেরকে মাদকমুক্ত করতে পুলিশের অভ্যন্তরে একটি শুদ্ধি অভিযানের পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, পুলিশ সদস্য মাদকাসক্ত-এটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভ্যন্তরে মাদকের বিষয়ে একটি শুদ্ধি অভিযান চালানো উচিত। পাশাপাশি কয়েক মাস পরপর ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এই দুটো কাজ করা গেলে পুলিশে মাদকাসক্ত কমে আসবে বলে মত এই আইনজ্ঞের।