বাবার খুনিদের শাস্তি চাই: ডা. নুজহাত

বাবার খুনিদের শাস্তি চাই: ডা. নুজহাত

রয়েল ভিউ ডেস্ক:
‘১৫ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি দোসর, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর কয়েকজন আমাদের পল্টনের বাসা থেকে বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে বাবাসহ আরও কয়েকজনের ক্ষত-বিক্ষত লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের পরিবারের লোকজন বাবাকে শনাক্ত করেন। ওই অমানুষরা বাবার বুকটা বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দেয়। বাবার সারা শরীরে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন। কপালের বাঁ দিকে আর তলপেটে ছিল বেয়নেটের গভীর ক্ষত। আর এসব নির্যাতনের প্রধান জল্লাদ ছিল আশরাফুজ্জামান।’

আর বলতে পারেন না ডা. নুজহাত। চুপ হয়ে যান। নিচের দিতে তাকিয়ে থাকেন। সেকেন্ড, মিনিট পার হয়। সময় পেরোয় তার গতিতে। দেয়াল ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। তার সামনে মাথা নত করে বসে থাকি আমি। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হয় না। কতক্ষণ কাটে জানি না! একসময় তার কণ্ঠ শুনে চমকে তাকাই তার দিকে। ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন তিনি। সরাসরি আমার চোখে তাকান। আলীমকন্যা নুজহাতের স্নিগ্ধ আর শান্ত দু’চোখ থেকে ক্রোধের আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে!

আবারও শুরু করেন তিনি। ‘বাবার অপরাধ ছিল, তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা তখন বেসামাল। মরিয়া হয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারফিউ দিত তারা। কারফিউ শেষ হলেই শুরু হত বাবার কাজ। বিভিন্ন ফার্মেসি আর ওষুধ কোম্পানি থেকে বিনামূল্যে ওষুধ সংগ্রহ করতেন বাবা। নিজের গাড়ির বনেট ভর্তি করে সেসব ওষুধ মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিতে পৌঁছে দিতেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য যে গোপন হাসপাতালটি ছিল, সেখানে গিয়ে চিকিৎসা দিতেন। এই সেবা পেয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সুস্থ হয়ে উঠতেন এবং পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যেতেন।’

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সা‌লে ডা. আলীম চৌধুরী‌কে ধ‌রে নি‌য়ে যাওয়া হয়। আস‌ছে ১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ৫০ বছর পূর্ণ হবে। বাবা আলীম চৌধুরী‌কে ধ‌রে নি‌য়ে যাওয়া, তার ক্ষত-‌বিক্ষত মৃত‌দেহ উদ্ধারসহ বি‌ভিন্ন বিষয় নি‌য়ে ডা. নুজহাতের সঙ্গে কথা হয়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমা‌দের দে‌শের কিছু বেঈমান আর বিশ্বাসঘাতকের সহযোগিতায় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আমাদের সূর্যসন্তানদের ধরে নিয়ে যায়। সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

সেদিনের ছোট্ট মেয়েটি আজ ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পা। নিজে দু’সন্তানের জননী। তার স্বামীও দেশের নামকরা চিকিৎসক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)।

স্মৃতি হাতড়ে নুজহাত বলেন, 'আমরা ছিলাম দুবোন। তখন বড় আপা ফারজানা চৌধুরী নীপার বয়স ছিল পাঁচের কাছাকাছি। আমার তখনও তিন বছর হয়নি। আমাদের বাসা ছিল ২৯/১ নম্বর পল্টন। মা শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ছিলেন উদয়ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বর্তমানে নিজের প্রতিষ্ঠিত উদ্দীপন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সেসময় বাবা নিজের এবং আমাদের পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন।’

বাবার সঙ্গে কাটানো খুব বেশি স্মৃতি তার মনে নেই। থাকার কথাও না। ডা. আলীম চৌধুরী যখন শহিদ হন, তখন ডা. নুজহাত তিন বছরেরও কম বয়েসি শিশু! বাবা সম্পর্কে এসব তথ্য দেওয়ার সময় আলীম চৌধুরীর ছোট মেয়ের চোখে-মুখে বাবার জন্য ভালোবাসার সেকি আকুতি! চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ে অশ্রু কণা। দ্রুতই সামলে নেন নিজেকে। কিন্তু তার রেশ থেকে যায় গলার স্বরে। দৃঢ় গলায় বলতে শুরু করেন ডা. নুজহাত। তার কণ্ঠে ঘৃণা, কষ্ট আর অভিমানের মিশেল। আমি তখন কেবলি সম্মোহিত শ্রোতা। নির্বাক হয়ে শুনছি। তাকিয়ে থাকি তার দিকে, কিন্তু আসলে কিছুই দেখি না।

নুজহাত বলে চলেন, ‘আপনারা জানেন- বাবাসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মাওলানা মান্নান। বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া ও হত্যার অপারেশন ইনচার্জ ছিল চৌধুরী মইনুদ্দীন। আর প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান। এই আশরাফুজ্জামান ছিল তৎকালীন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। বুদ্ধিজীবীদের ধরে যে গাড়িতে করে রায়ের বাজারের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হত, সেই গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দীন ধরা পড়ার পর তার জবানবন্দিতে আশরাফুজ্জামানের পরিচয় পাওয়া যায়।’

এরপর আর সূত্রধরের প্রয়োজন পড়ে না। কথায় পেয়ে বসে নুজহাতকে। কোথাও খেই না হারিয়ে বলতে থাকেন, ‘স্বাধীনতার পরে আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করেন। সেই ডায়েরির দুই পৃষ্ঠাজুড়ে ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়। যাদের মধ্যে ৮ জনকে হত্যা করা হয়। এঁরা হলেন- মুনীর চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রশিদুল হাসান, ড. ফয়জুল মহী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. গোলাম মুর্তজা। এই ৮ জনের সবাইকে নিজের হাতে গুলি করে আশরাফুজ্জামান হত্যা করেছে বলে জবানবন্দী দেয় ড্রাইভার মফিজুদ্দিন।’

একটু বিরতি নেন নুজহাত। সেটা সামান্য সময়ের জন্য। তারপর পাশ থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ছোট্ট একটু চুমুক দেন। আবারও বলতে শুরু করেন তিনি।

‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড অপারেশনের ইনচার্জ চৌধুরী মইনুদ্দীন আর প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। চৌধুরী মইনুদ্দীন বর্তমানে ইংল্যান্ডে এবং আশরাফুজ্জামান আমেরিকার নিউ ইয়র্কে বিশাল মুসলিম নেতা, ইসলামী চিন্তাবিদ হিসাবে দিন কাটাচ্ছে! যুক্তরাজ্য ও আমেরিকা সরকার যুদ্ধাপরাধী এই দুই জনকে বেশ নিরাপদেই রেখেছে! স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়ে গেল। অথচ আজ পর্যন্ত তাদের ফিরিয়ে এনে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেল না! বাবার খুনিদের শাস্তি আজও হলো না। এর চেয়ে বড় কষ্ট, দুঃখ আর অপমানের কিছু নেই আমাদের কাছে।’

কেবল বাবার কথা বলেই ক্ষান্ত হননি নুজহাত। ’৭১ সালে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পরিকল্পিতভাবে দেশের যেসব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের খুঁজে খুঁজে নৃশংসভাবে খুন করা হয়, তাদেরও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন তিনি। বিশাল সেসব শহিদদের তালিকা। যার মধ্যে রয়েছেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রকৌশলী ১৬ জনসহ মোট ১ হাজার ১১১ জন।

শীতের বিকেল দ্রুতই শেষ হয়। নুজহাতের কথাও শেষ হয়। আসলেই কি শেষ হয়? সময় গড়িয়ে যায়। ঠান্ডা চায়ের কাপে চুমুক দিই। এবার আলাপচারিতায় আনুষ্ঠানিক ইতি টানতে হয়। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য উঠে দাঁড়াই। তিনিও আমার সঙ্গে সদর দরজা পর্যন্ত আসেন। বিদায় নিয়ে দরজার বাইরে পা রাখি। বাইরে আস্তে আস্তে আঁধার নামছে। এ সময়টায় এমনিতেই মন বিষণ্ন হয়ে পড়ে। মাইকে মাগরিবের আজান হচ্ছে। বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়...।

[১ হাজার ১১১ জন মানুষ। শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রকৌশলী। দেশের সূর্যসন্তান। যাদের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পরিকল্পিতভাবে ধরে নিয়ে যায়। তারপর অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এদের অনেকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া প্রায় রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। তাদেরই একজন শহিদ ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী। তার ছোট মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পার বয়ানে তার বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে রায়ের বাজারে ডা. আলীম চৌধুরীর ক্ষত-বিক্ষত লাশের সন্ধান পাওয়ার দুঃসহ স্মৃতির কথা।

শহিদ ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর জন্ম ১৯২৮ সালের ১৬ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ জেলার খয়েরপুর গ্রামে। কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে মেট্রিক এবং কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আইএসসি পাস করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে এমবিবিএস এবং ১৯৬১ সালে লন্ডন থেকে ডিও ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ৫২’র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন]।