‘বুস্টার ডোজ নিয়েও ওমিক্রন সংক্রমণের শঙ্কা’

‘বুস্টার ডোজ নিয়েও ওমিক্রন সংক্রমণের শঙ্কা’

রয়েল ভিউ ডেস্ক :
করোনাভাইরাসের দাপট কাটিয়ে ওঠার আগেই আবারও নতুন ধরন ওমিক্রণ আতঙ্কে উদ্বিগ্ন বিশ্ববাসী। এরিমধ্যে দেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনে বিপুলসংখ্যক মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই বুস্টার ডোজসহ তিন ডোজ গ্রহণ করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা সংক্রমণের পেছনে ওমিক্রনের প্রভাবকে দায়ী করলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সংক্রমণ বাড়লেও আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। হাসপাতালে ভর্তি রোগী সংক্রমণ অনুপাতে বাড়েনি। বেশি ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী শনাক্তহীন অবস্থায় আছেন। আবার পাঁচ থেকে সাত দিনেই আক্রান্ত ব্যক্তি এমনিতেই সুস্থ হচ্ছেন। তবে স্বাস্থ্যবিধি ও কোয়ারেন্টাইন মানতে হবে।

করোনা সংক্রমণের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় আসার কয়েকদিনের ব্যবধানে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আবারও বেড়েছে ২৬ শতাংশ। ওমিক্রনের প্রভাবে দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।

বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে ‍২৪ ঘণ্টায় ৩৭ হাজার ৮৩০টি করোনা পরীক্ষায় নয় হাজার ৫০০ জন এই ভাইরাসে শনাক্ত হয়েছেন। এই সময়ে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ২৫ দশমিক ১১ শতাংশ। তবে শুরু থেকে মোট পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। গতকাল মঙ্গলবার শনাক্ত হয়েছিল আট হাজার ৭০৪ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ১১ শতাংশে, যা গত বছরের ১৩ আগস্টের পর সর্বোচ্চ। ওই দিন শনাক্তের হার ছিল ২৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪২ হাজার ২৯৪ জনে। একদিনে আরো ১২ জনের মৃত্যু হওয়ায় রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ১৭৬ জন। সরকারি হিসাবে গত একদিনে দেশে সেরে উঠেছেন ৪৭৩ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ২৬৮ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

বিচলিত না হবার পরামর্শ দিয়ে ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জামালউদ্দিন বলেন, সম্প্রতি এই স্ট্রেইনটি সাধারণ ঠান্ডা-জ্বর বা ফ্লু এর সাথে একযোগে আক্রান্ত করছে এবং শীতকালীন শীতাতপের তারতম্যে এর বিস্তার ব্যাপকতা পেয়েছে। শতকরা ৮০ ভাগ (হার্ড ইমিওনিটি) আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত এটির সংক্রমণ চলবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তাই এতে আক্রান্ত হলে বিচলিত না হয়ে উপসর্গ (নাক দিয়ে পানি ঝরা, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, মাথা ব্যাথা, গলা ব্যাথা, হালকা কাশি প্রভৃতি) থাকলে পজিটিভ হয়েছেন ধরে নেয়া (যেহেতু কম ক্ষতিকর তাই পরীক্ষার ফলাফলে মানসিক বিপর্যস্ততা না আনাই শ্রেয়) আর সেমতে কমপক্ষে ৭ দিন আইসোলেশনে থেকে উপসর্গ কমলে বা না থাকলে পরে স্বাভাবিক কাজ কর্মে ফেরাই যুক্তিযুক্ত।

মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে যেসব ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর নমুনা নেওয়া হয়েছে তাদের অনেকেই দুই ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। কেউ কেউ তৃতীয়বারের মতো সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে হাসপাতালে ভর্তি রোগী থেকে সংগৃহীত নমুনা জিনোম সিকোয়েন্স করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।

তিনি বলেন, ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রন ধরনে অনেক বেশি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে প্রতিয়মান। ওমিক্রনের জেনেটিক কোডে ডেল্টার চেয়ে বেশি ডিলিশন মিউটেশন পাওয়া গেছে। যার বেশিরভাগ ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন রয়েছে। এ স্পাইক প্রোটিনের ওপর ভিত্তি করে বেশিরভাগ টিকা তৈরি করা হয়। স্পাইক প্রোটিনের বদলের কারণেই প্রচলিত ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও ওমিক্রন সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়।

বিএসএমএমইউর চলমান গবেষণার ছয় মাস ১৫ দিনের ফল। এতে রিপ্রেজেন্টেটিভ স্যাম্পলিং করা হয় দেশের সব বিভাগের। গবেষণায় মোট ৭৬৯ কোভিড পজিটিভ রোগীর ন্যাজোফ্যারিনজিয়াল সোয়াব স্যাম্পল থেকে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। গবেষণায় ৯ মাস থেকে শুরু করে ৯০ বছর বয়সী রোগী অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এর মধ্যে ২১ থেকে ৫৮ বছর বয়সের রোগীর সংখ্যা বেশি। যেহেতু কোনো বয়সসীমাই কোভিডের জন্য ইমিউন করছে না, সে হিসেবে শিশুদের মধ্যেও সংক্রমণ রয়েছে। এ ছাড়া যাদের কো-মরবিডিটি রয়েছে যেমন- ক্যানসার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস তাদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি ষাটোর্ধ্বদের দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি দেখা গেছে।

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম)-এর ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জামালউদ্দিন বলেন, করোনায় নুতনভাবে ওমিক্রন অথবা ডেলমিক্রন যা দিয়েই আক্রান্ত হোক, নুতন স্ট্রেইন শ্বাসতন্ত্রের ভেতরে যেতে না পেরে উপরের অংশ আক্রান্ত হয়। আর তাই এটি মারাত্বক নয় বলেই প্রতীয়মান অর্থাৎ এতে আক্রান্ত ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। আর পাঁচ থেকে সাত দিনেই আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হচ্ছেন।

তিনি আরো বলেন, এ স্ট্রেইন এ স্পাইকের নিয়মিত বিবর্তনের ফলে বুস্টারসহ পূর্ণ তিন ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহিতাকেও আক্রান্ত করতে পারে। অর্থাৎ ব্যবহিত ভ্যাকসিন সংক্রমণ প্রতিরোধী নয় তবে ভ্যাকসিনের প্রভাবে শরীরে এন্টিবডির প্রাচুর্য থাকায় অন্যান্য ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকাংশে কম।

বর্তমান জীবনযাপন পদ্ধতি এবং সামাজিক পরিস্থিতি সংক্রমণ বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

গবেষণার বরাত দিয়ে আরো জানানো হয়, কোভিড-১৯ জেনোম সিকোয়েন্সিং বিশ্লেষণে গত বছরের জুলাইতে দেখা যায়, মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ ছিল ডেল্টা ধরনে। ১ শতাংশ সংক্রমিত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত করোনার বেটা ধরনে।

এ ছাড়া ১ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে যাওয়া যায় করোনার মরিসাস ধরন অথবা নাইজেরিয়ান ধরন। অন্যদিকে জুলাই থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জিনোম সিকোয়েন্সে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৯৯.৩১ শতাংশ ছিল ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত রোগী। কিন্তু ৮ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি ৬পর্যন্ত সংগৃহীত নমুনার ২০ শতাংশেই ওমিক্রন ধরন মিলেছে। বাকি ৮০ শতাংশ রোগী ডেল্টায় সংক্রমিত।

অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনা প্রত্যেক ধরনই বিপজ্জনক এবং তা মারাত্মক অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। তাই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে হবে।

বুধবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুরে স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালগুলোতে কোভিড ডেডিকেটেড যেসব শয্যা আছে, সেগুলোর মধ্যে ঢাকার পরিসংখ্যান যদি দেখি, চার হাজার ৬৮৬টি শয্যার বিপরীতে তিন হাজার ৭১০টি শয্যা এখনও খালি রয়েছে। নতুন করে করোনায় রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা সে অনুপাতে বাড়েনি। তবে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই।

নাজমুল ইসলাম বলেন, আমাদের অক্সিজেনের সংকট নেই। অক্সিজেন সিলিন্ডার, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলা, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, এ গুলো প্রয়োজন অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণ মজুত আছে।