বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ, প্রস্তুতিতে পিছিয়ে

বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ, প্রস্তুতিতে পিছিয়ে

ডেস্ক রিপোর্ট:
মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে সারাদেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আছে। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভূমিকম্পের তেমন কোনো পূর্বাভাস ব্যবস্থা নেই। সেজন্য দিন-ক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ, সেটা হতে পারে যে কোনো সময়। কিন্তু ঝুঁকি থাকলেও তা মোকাবিলার প্রস্তুতিতে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। বহু পুরোনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা—ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবলেরও সংকট রয়েছে।

ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের সামর্থ্য বোঝাতে অনেকে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের ঘটনাকে তুলে ধরেন। সেসময় পুরো শক্তি কাজে লাগিয়ে ওই ভবনটি পুরোপুরি উদ্ধারে প্রায় এক মাস লেগে যায়। গত বছরের ২৯ মে দেশের ইতিহাসে প্রথম একই অঞ্চলে একদিনে চার দফা ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। আবহাওয়া ও ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ওইদিন সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৩ মাত্রার, সকাল ১০টা ৫০ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ৪ দশমিক ১ মাত্রার, বেলা ১১টা ২৯ মিনিট ৫১ সেকেন্ডে ২ দশমিক ৮ মাত্রার এবং দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের জৈন্তাপুর ও এর আশপাশে। এর পরদিন ৩০ মে ভোর ৪টা ৩৫ মিনিট ৭ সেকেন্ডে ফের দুই দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দফায় দফায় স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস।

ভূমিকম্প কেন হয়: পৃথিবী প্লেট ও সাব-প্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দুই প্লেটের মধ্যে যে ফাঁকা থাকে তাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। প্লেটগুলো গতিশীল। দুটি চলন্ত প্লেটের ফল্ট লাইনে পরস্পর সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্ট লাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়।  ভূমিকম্পের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের উত্তর এবং পূর্বাংশের শহরগুলো। রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের কাছাকাছি অবস্থান করছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভূমিকম্প সহনীয় দেশ গড়তে নানা ধরনের কার্যক্রম চলমান। সহায়তা পেতে জাপান সরকারের সঙ্গে একটি বড় ধরনের সমঝোতার পথে হাঁটছে সরকার। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক তৈরি, উন্নত যন্ত্রপাতি কেনার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি মহড়ার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।

বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলে রয়েছে। অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশ ও আশপাশে হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এটা কিন্তু হবে। বাংলাদেশের আশপাশে ভূমিকম্পের ইপি সেন্টার বা কেন্দ্র আছে। এই কারণে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। তবে এটা কবে হবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। আগামীকাল হবে, নাকি ১০০ বছর পরে হবে, নাকি ২০০ বছর পরে হবে- এটা স্টাডির ব্যাপার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৭ মাত্রার মতো বড় ভূমিকম্প হয়েছে মানিকগঞ্জে ১৮৮৫ সালে। এটার নাম ছিল বেঙ্গল আর্থকোয়াক। আরেকটা হয়েছে শ্রীমঙ্গলে ১৯১৮ সালে, এটার নাম শ্রীমঙ্গল আর্থকোয়াক। শ্রীমঙ্গল আর্থকোয়াকের উৎপত্তিস্থলের আশপাশে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে টাঙ্গাইল, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তবে ওই ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

সাধারণত ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্র যদি কোনো স্থানের ১০০ কিলোমিটার দূরে হয় তাহলে ওই স্থানের ক্ষয়ক্ষতি কম হয় জানিয়ে এই ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী বলেন, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক’ ভারতবর্ষে আঘাত হানে। গবেষকরা এখন হিসাব করে বের করেছেন, এটার মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১। ওই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের মেঘালয়ের শিলং শহর। ওই ভূমিকম্পে ঢাকা শহরেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

‘এতে প্রমাণ হয়, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। এটা কখন হবে, আমরা হিসাব করে বের করতে পারিনি। অনেকে বলেন, ১০০ বছর পরপর বড় ভূমিকম্প হয়, এটা ঠিক নয়। ৩০০ বছর পর, ৫০০ বছর পরও হতে পারে। তবে অবশ্যই ঝুঁকিতে আছি আমরা।

ড. জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের বাউন্ডারির কাছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় কোনো ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি (ফল্ট) আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি। বাংলাদেশের বাইরে সীমান্ত সংলগ্ন ফল্ট আছে। ত্রিপুরা, মিজোরাম, ডাউকিতে ফল্ট রয়েছে। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের উত্তর এবং পূর্বাংশের শহরগুলো। রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। ঢাবির ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী এ অধ্যাপক আরও বলেন, আমাদের অবকাঠামোগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা ভূমিকম্প সহনীয় ভবন করি না। এছাড়া অনেক পুরোনো ভবন রয়েছে। এসব ভবন অরক্ষিত (ভালনারেবল), বিপদ (হ্যাজার্ড) আছে- তাই ঝুঁকি তো থাকবেই। অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণের কারণে আমরা নিজেদেরকেই ঝুঁকিতে ফেলেছি। রাজধানী ঢাকাও ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে।

বেহাল প্রস্তুতি: ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি অত্যন্ত নাজুক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়। আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। সরকারের সব সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে পুরো ভবনটি উদ্ধারে সময় লাগে প্রায় এক মাস। এখনো সেই অবস্থা থেকে খুব একটা উন্নতি হয়নি উদ্ধার কার্যক্রমের। তাই ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে শত শত ভবন ধসে পড়লে তা উদ্ধারে তেমন কিছু করার থাকবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকট তো রয়েছেই, এর ওপর ঢাকার রাস্তাগুলোর যে অবস্থা, বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে অনেক এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রম দূরের কথা, রাস্তার কারণে প্রবেশই করা যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। রানা প্লাজা ধসের পর আমরা দেখেছি এটি উদ্ধার করতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। পুরো সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে এটি উদ্ধারে আমাদের অনেক দিন লেগে গেছে। বড় ভূমিকম্প হলে শত শত ভবন ধসে গেলে কীভাবে উদ্ধার করা হবে, তা আল্লাহই ভালো জানেন। আমাদের ওই ধরনের যন্ত্রপাতি কিংবা প্রস্তুতি- কোনোটাই নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক মো. শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য আমাদের তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। বিল্ডিং কোড না মানা হলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আমরা কমাতে পারবো না। পুরোনো ভবনের ঝুঁকি নির্ণয় করে সেগুলো রেট্রোফিট করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ভূমিকম্প ঝুঁকির ক্ষেত্রে মূল বিষয় হচ্ছে আমাদের ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনীয় কি না। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। উত্তর সিটি করপোরেশনেও বহু পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। তাই ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের প্রাথমিক প্রস্তুতি কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কী পরিমাণ সরঞ্জাম আছে সেটা নয়। প্রাথমিক প্রস্তুতি হলো বিল্ডিং কোড মেনে ভবনগুলো তৈরি করা হলো কি না। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ঢাকার রাস্তাগুলো উদ্ধার কার্যক্রমে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। ১৮ কোটি মানুষের জন্য ফায়ার সার্ভিসের জনবল মাত্র ১৩ হাজার। ফায়ার সার্ভিস, রেডক্রস- এদের দিয়ে এককভাবে এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করা যাবে না। জনগণকেই ভলান্টিয়ার হিসেবে তৈরি থাকতে হবে, যোগ করেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।

মোকাবিলায় যা করছে সরকার: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, বাংলাদেশকে ভূমিকম্প সহনীয় দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে জাপানের সঙ্গে চার দফা মিটিং হয়েছে। আমাদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক তৈরি হয়েছে। সেই অনুযায়ী তিনটি ধাপে বাংলাদেশকে ভূমিকম্প সহনীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। আমরা ফোকাল পারসন নিয়োগ দিয়েছি, কার্যক্রম এগোচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী জানান, প্রথম দফায় তারা সচেতনতা বাড়াতে কাজ করবেন। দ্বিতীয় দফায় ১০০/২০০ বছরের পুরোনো যেসব বিল্ডিং আছে, সেগুলো ধ্বংস করে জাপানের আর্থিক সহায়তায় ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া সম্প্রতি যেসব ভবন তৈরি করা হয়েছে সেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় কি না তা পরীক্ষার করে সংস্কার করা হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-১ অনুবিভাগ) রঞ্জিৎ কুমার সেন বলেন, ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় ভলান্টিয়ার গ্রুপ করা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণসহ কিছু অত্যাবশকীয় সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ইর্মাজেন্সি অপারেশন সেন্টার রয়েছে। এছাড়া রয়েছে জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র (এনডিআরসিসি)। বড় পরিসরে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনওইসি) করা হচ্ছে, তেজগাঁওয়ে জায়গা নেওয়া হয়েছে। চীনের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো এমওইউ হবে। এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।

রঞ্জিৎ কুমার সেন আরও বলেন, এনওইসি প্রকল্পের অধীনে ভূমিকম্প মোকাবিলায় হেলিকপ্টার, হোভারক্রাফটসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনা হবে। আমরা ভূমিকম্পের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নিয়মিত মহড়া করছি। গত ৯ মার্চ একটি বড় সেমিনার করেছি। সেখানে আমাদের প্রস্তুতিতে কী ঘাটতি রয়েছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম (এনআরপি) রয়েছে। অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্প ও বন্যা নিয়ে মূলত কাজ করা হয়। ফায়ার সার্ভিস ভূমিকম্প নিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সভা, সেমিনারসহ জনগণকে সচেতন করার কাজ করছি। অন্যদের সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে কাজ করা হচ্ছে। তবে আমাদের জন্য বড় ঝুঁকি হচ্ছে ভবনগুলো।

অতিরিক্ত সচিব বলেন, জাপানের মতো বাংলাদেশেও ভূমিকম্পের আগে পূর্বাভাস দেওয়া যায় কি না সেটা স্টাডির পর্যায়ে আছে। বুয়েট, আবহাওয়া অধিদপ্তর, জাপান সরকার ও রাজউক মিলে এ বিষয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মেনে চলতে পারলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে নতুন ভবনগুলো ধসে পড়ার ঝুঁকি থাকবে না। এটা সবাইকে মেনে চলতে হবে, বলেন রঞ্জিৎ কুমার সেন।

যা করতে হবে: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মানার কোনো বিকল্প নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দ্রুত ভেঙে ফেলতে হবে। বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক গড়ে তুলতে হবে, উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোর জনবল বাড়াতে হবে। তারা আরও বলেন, ভূমিকম্প নিয়ে মানুষকে সচেতন করা খুবই জরুরি। পাঠ্যসূচিতে ভূমিকম্পসহ দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নতুন ভবন ভূমিকম্প সহনীয় করে বানাতে হবে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন করতে হবে। আর পুরোনোগুলো রেট্রোফিটিং বা ভূমিকম্প সহনীয় করার জন্য সংস্কার করতে হবে। ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় ভবন করলে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে না। এখন থেকে আগামী ২০ বছর যদি আমরা নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করি তাহলেও ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে আনা যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ঝুঁকি কমানোর জন্য আমাদের নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভূমিকম্প হলে যারা উদ্ধার কার্যক্রম চালাবেন তাদের প্রস্তুত রাখতে হবে। নতুন ভবনের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মানতে হবে। কোনোস্থানে নতুনভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে হলে ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় নিতে হবে। নতুন গড়ে ওঠা শহরে ইর্মাজেন্সি রাস্তা, ফায়ার স্টেশনগুলো সঠিক জায়গায় স্থাপন করতে হবে। ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকির বিষয়টি সরকারকে পুরো উপলব্ধি করতে হবে। এ বিষয়ে বিশদ গবেষণারও প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিসমিক সোর্স মডিউলিং করা। এরপর ধাপে ধাপে পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার অনেক কিছু করছে। একটা সময় মানুষ ভূমিকম্প নিয়ে সেভাবে কিছু জানতোই না। বিষয়টি আলোচনাই হতো না। গত ১০ বছরে মানুষ জানে ভূমিকম্প কী। এ বিষয়ে অনেক সচেতনতা এসেছে। এটা সরকারের পদক্ষেপের কারণেই সম্ভব হয়েছে। মানুষকে সচেতন করার কাজটি আরও এগিয়ে নিতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, দুর্বল ভবনগুলো দ্রুত ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করতে হবে। নতুন ভবনগুলো অবশ্যই বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া প্রচুর সংখ্যক ভলান্টিয়ার তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলার মৌলিক বিষয় যুক্ত করতে হবে। তাহলে সচেতন নাগরিক হিসেবে সে গড়ে উঠবে। ‘রানা প্লাজা ধসের পর পুরো উদ্ধার করতে এক মাসের মতো সময় লেগেছে। এখন ঢাকায় যদি ভূমিকম্পে শত শত ভবন ধসে পড়ে তবে কী অবস্থা হবে! তাই এসব দুর্যোগ একাধিক উপায়ে মোকাবিলা করতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক আরও বলেন, নানা ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় নতুন নতুন ফায়ার সার্ভিস স্টেশন তৈরি হচ্ছে। জনবল নিয়োগ এবং বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে সরঞ্জাম কেনার কাজ ক্রমাগত চলছে।