ভারতীয়দের চোখে কি রাজনীতিবিদ হিসেবে নারীরাই সেরা?

ভারতীয়দের চোখে কি রাজনীতিবিদ হিসেবে নারীরাই সেরা?

ডেস্ক রিপোর্ট:

নারী ও পুরুষ একই দক্ষতায় রাজনৈতিক নেতৃত্বদান করে থাকে বলে মনে করেন অধিকাংশ ভারতীয়। এছাড়া প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজনেরও বেশি ভারতীয় মনে করেন যে নেতৃত্বগুণে নারীরা পুরুষের থেকে এগিয়ে আছে। মাত্র এক-চতুর্থাংশ ভারতীয় মনে করেন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পুরুষরা নারীদের চেয়ে ভালো করে থাকেন।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি ভারতের প্রায় ৩০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

ভারতে নারীরা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় নারী যিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের বর্তমান সংসদের প্রায় ১৪ শতাংশ নারী। ১৯৫২ সালে এই হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ।

কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটির রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ খুব কম। গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মসের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুসারে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসভা নির্বাচনের ৫০ হাজার প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ নারী। সংসদে নারীর উপস্থিতির দিক থেকে বিশ্বে ১৯৩টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৪৪তম। জাতীয় সংসদ ও রাজ্যসভার এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার বিল ১৯৯৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে।

কিংস কলেজ লন্ডনের এলিস ইভানসের মতো সমাজবিজ্ঞানীরা এ ধরনের গবেষণা নিয়ে আশা প্রকাশ করেন। তবে জেন্ডার সমতা নিয়ে গবেষণা করা ইভানস বলেন, "বিষয়টিকে আমাদের নারী নেতৃত্বের জন্য বাড়তে থাকা সমর্থন হিসেবে দেখা উচিত নয়। ভারতের নারীরা এখনও প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার।"

ভারতে নির্বাচনে নারীর জয়লাভের কোনো বাস্তবিক প্রভাব নেই বলে জানান ড. ইভানস। তিনি বলেন, "পদে পদে বাধা থাকার কারণে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঠে ভারতীয় নারীদের চরম সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হয়। বন্ধুবান্ধব ও সমবয়সীদের সঙ্গে নারীদের একত্রিতভাবে কাজ করার সুযোগ কম, জাগতিক অভিজ্ঞতা নিয়েও তাদের খুব বেশি ধারণা থাকে না। অচেনা পুরুষদের সঙ্গে জোট বাঁধা কিংবা প্রচারণা তহবিল সংগ্রহ করতেও তাদের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়।"

পাঁচ ভাগের চার ভাগ ভারতীয় নারীই বিনা বেতনে কাজ করেন। ছবি: এএফপি
ভারতের অনেক নারীনেত্রীই সুবিধাজনক অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ধনাঢ্য পরিবারের, উচ্চ বংশীয় এবং উঁচু জাতের। এছাড়া অনেকেই বংশ পরম্পরায় রাজনীতিতে এসেছেন। রাজনীতি এখনও সাধারণ নারীদের আওতায় আসেনি বলে মন্তব্য করেন ড. ইভানস।

উন্নত অর্থনীতির দেশ নিয়ে গঠিত অর্থনৈতিক সংস্থা ওইসিডির দেশগুলোয় পরিচালিত এক পৃথক গবেষণায় দেখা যায় যে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকা দেশগুলোর রাজনীতিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব বেশি। এছাড়া রাজনৈতিক দলে নারীদের প্রতিনিধিত্বের হার ও ভোটদানের অনুপাতও প্রায় সমান।

তবে পিউ রিসার্চের জরিপ অনুসারে ঘরে নারীর তুলনায় পুরুষের আধিপত্য থাকা উচিত বলে মনে করেন অধিকাংশ ভারতীয়।

প্রতি ১০ জনের মধ্যে নয়জন ভারতীয় এই ধারণার সাথে একমত যে একজন স্ত্রীর উচিত সর্বদা স্বামীর বাধ্য থাকা। মজার বিষয় হলো এবিষয়ে পুরুষদের সঙ্গে নারীদের খুব একটা মতপার্থক্য নেই।

ড. ইভানসের মতে, বিষয়টি আশ্চর্যজনক নয়। ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলই গ্রামীণ। নারীদের বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও থাকে সীমিত। ফলে মিলিতভাবে তারা বৈষম্য নিয়ে আলোচনার সুযোগ পায়। পুরুষ কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে এবং নারীরা তা মেনেও নেয়।

তবে জরিপ অনুসারে ঘরের কিছু কাজে নারী-পুরুষের সমানভাবে অংশ নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন ভারতীয়রা। ৬২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বলেন সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব নারী ও পুরুষ উভয়ের।

এছাড়া এখনও ভারতের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মতো একটি বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী মনে করে যে শিশুর যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব নারীর একার।

৫৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর মতে, পরিবারে নারী ও পুরুষ উভয়ের কাঁধেই অর্থ উপার্জনের দায়িত্ব থাকা উচিত। তবে উপার্জনের বিষয়টিকে ৪৩ শতাংশ ভারতীয় প্রধানত পুরুষের দায়িত্ব হিসেবে দেখেন। অধিকাংশ ভারতীয় মনে করেন, চাকরির সংকট থাকলে নারীর তুলনায় পুরুষদের কর্মসংস্থানের অধিকার থাকা বেশি জরুরি।

ইভানসের মতে, ভারতীয়রা নারীর উপার্জনকে সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে এক পাল্লায় তুলে পরিমাপ করেন। নারীরা ভালো উপার্জন করলেই কেবল পারবারিক মর্যাদা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানো হয় না। নারী গ্র্যাজুয়েটরা বর্তমানে আইটি, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেলিকম, ফিন্যান্স এবং পরিষেবা খাতে ক্যারিয়ার গড়ছেন। কিন্তু ভারতে নারীদের চাকরি পাওয়া সহজ নয় বলেও মনে করেন এই গবেষক। তার মধ্যে এখানে চাকরি পেতে সকলকেই দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। আর নারীরা থাকে এই লাইনের একদম শেষ দিকে।

তবে সমীক্ষার একটি উদ্বেগজনক ফলাফল হলো, এখনো অনেক ভারতীয়ই ক্ষেত্রবিশেষে কন্যাশিশুর ভ্রুণহত্যা সমর্থন করেন। ভারতে আইনিভাবে বিষয়টি নিষিদ্ধ হলেও অংশগ্রহণকারীদের অনেকে মনে করেন যে বিশেষ পরিস্থিতিতে লিঙ্গ যাচাই পূর্বক গর্ভপাতের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য।

প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন ভারতীয় গর্ভপাতের বিষয়টিকে পুরোপুরি বা আংশিক সমর্থনযোগ্য বলে মনে করেন। ভ্রুণহত্যা শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করার পরিবর্তে তারা বিষয়টিকে, 'পরিবারে ছেলেমেয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা', 'গর্ভবতী অবস্থায় আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির শরণাপন্ন হওয়া' এরকম সব বিকল্প কথাবার্তার মাধ্যমে যৌক্তিক করে তোলার চেষ্টা করেন।

এই বিষয়ে ধর্মভেদে খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায় না। ৪৩ শতাংশ খ্রিশ্চান, ৪০ শতাংশ হিন্দু, ৪০ শতাংশ জৈন, ৩৮ শতাংশ শিখ ও ৩৭ শতাংশ মুসলিম বিষয়টি গ্রহণযোগ্য মনে করেন। প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই প্রতি পাঁচজনের একজন লিঙ্গ-নির্ধারণ পূর্বক গর্ভপাত করানোর বিষয়টি পুরোপুরি সমর্থন করেন।

তাহলে এই গবেষণা ভারতের জেন্ডার সমতা সম্পর্কে কী বলছে?

এ কথা সত্যি যে ভারতীয় নারীরা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে শিক্ষা, উত্তরাধিকার বিবাহ বিচ্ছেদ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন। বিভিন্ন নারী আন্দোলনেও তাদের সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। পরিবারের সদস্যদের শবদাহ করতে চিতা জ্বালানোর মতো জনসম্মুখে বহু চিরাচরিত সামাজিক প্রথাই ভাঙছে তারা।

"কিন্তু নারীদের অধিকার আদায় ও পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ভাঙার প্রচেষ্টায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সামাজিক বিভক্তি একটি বড় বাধা। অধিকার আদায়ের জন্য সবার আগে তাদের ঘরের বাইরে বের হতে হবে। সেজন্য নারীর কর্মক্ষেত্রের বিকাশ ও নিরাপদ চলাচলের নিশ্চয়তা থাকা জরুরি," বলেন ড. এলিস ইভানস।

সূত্র: বিবিসি থেকে অনূদিত