রায়হান হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু

রায়হান হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু

কাউসার চৌধুরী
সিলেট নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে সিলেট মহানগর দায়রা জজ মো. আব্দুর রহিমের আদালতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচার শুরু হয়। দন্ডবিধির ৩০২/২১০/৩৪ তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩ এর ১৫(১) (২)(৩) ধারায় দারোগা আকবরসহ সকল আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি এডভোকেট নওশাদ আহমদ চৌধুরী বহুল আলোচিত রায়হান হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। গতকাল সোমবার বিকেলে সিলেটের ডাককে তিনি বলেন, আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ অন্যান্য আসামিদের উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে রায়হান হত্যাকান্ডের বিচার শুরু হলো। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলা থেকে তাদের অব্যাহতির জন্যে আবেদন করেছিলেন। তবে, আদালত ওই আবেদন আমলে না নিয়ে খারিজ করে দেন।

মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানান, আগামী ১০ মে পরবর্তী ধার্য তারিখে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। ওই দিন বাদীসহ দুয়েকজন সাক্ষ্য দেবেন বলে আশা করা যায়।

জানা গেছে, রায়হান হত্যা মামলার ধার্য্য তারিখ ছিল গতকাল সোমবার। এজন্যে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত ইনচার্জ এস আই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, দারোগা হাসান উদ্দিন, এএসআই আশেকে এলাহী , কনস্টেবল টিটু চন্দ্র ও কনস্টেবল হারুনুর রশিদকে কড়া প্রহরায় শহরতলীর বাদাঘাটস্থ সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। দুপুরে সিলেটের মহানগর দায়রা জজ মো. আব্দুর রহিমের আদালতে আসামিদেরকে তোলা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে মহানগর পিপি এডভোকেট নওশাদ আহমদ চৌধুরী মামলার অভিযোগ গঠন করতে আবেদন করেন। দারোগা আকবরসহ ৫ আসামির উপস্থিতিতে এডভোকেট নওশাদ অভিযোগ গঠনের পক্ষে দীর্ঘ শুনানী করেন। শুনানীর পর আদালত মামলার অভিযোগ গঠন করেন।

অভিযোগ গঠনকালে মামলার অপর আসামি আব্দুল্লাহ আল নোমান পলাতক রয়েছে।

রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগ গঠনের জন্যে কয়েক দফা তারিখ নির্ধারণ করেও শেষ পর্যন্ত অভিযোগ গঠন পিছিয়ে গিয়েছিল।
সর্বশেষ গেল ১২ এপ্রিল মঙ্গলবার ধার্য তারিখ ছিল। ওই দিন আসামিদের পক্ষে ডিসচার্জ পিটিশন দাখিল ও এর শুনানি না হওয়ায় অভিযোগ গঠনের তারিখ আবারও পিছিয়ে যায়। অবশেষে আসামি, আইনজীবীদের উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের ফলে রায়হান হত্যাকান্ডের বিচার শুরু হলো।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৮ মার্চ সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আব্দুল মোমেনের আদালত থেকে মামলাটির বিচার কার্যক্রমের জন্যে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তরিত হয়। গেল বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সিলেটের অতিরিক্ত মূখ্য মহানগর হাকিম আব্দুল মোমেনের আদালত রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক আসামি কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। এরপর পলাতক নোমানের মালামালও ক্রোক করা হয়। এরপর দেয়া হয় পত্রিকা বিজ্ঞপ্তিও। এরপরও আসামি হাজির না হওয়ায় আসামির অনুপস্থিতিতে শুরু হলো বিচার কার্যক্রম।

এর আগে গেল বছরের ৫ মে বুধবার আলোচিত রায়হান হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই সিলেটের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন ৫ আসামির বিরুদ্ধে দন্ডবিধি ৩০২/২১০/৩৪ তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩ এর ১৫(১) (২)(৩) ধারায় সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আব্দুল মোমেনের আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। দীর্ঘ ২০২ দিনের তদন্ত শেষে দেয়া অভিযোগপত্রে দারোগা আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামী করে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৫ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে আাসমী করা হয়। অভিযোগপত্রসহ কেস ডকেট ১ হাজার ৯৬২ পৃষ্ঠা। তবে মূল অভিযোগপত্র ২২ পৃষ্ঠার। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয়েছে ৬৯ জনকে। সাক্ষীদের মধ্যে ১০ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার বাগইর গ্রামের মো. জাফর আলী ভূঁইয়ার পুত্র দারোগা আকবর হোসেন ভূঁইয়া (৩২) , হবিগঞ্জের মোহনপুরের মৃত আমির হোসেনের পুত্র দারোগা হাসান উদ্দিন (৩২) , ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চামারুল্লা গ্রামের মৃত আতাউল করিমের পুত্র এএসআই আশেকে এলাহী (৪৩), সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার উক্তচন্দ্র গ্রামের অনিল কুমার দাসের পুত্র কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার একডালা গ্রামের আব্দুন নুরের পুত্র কনস্টেবল হারুনুর রশিদ (৩২) ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বড়দেও (শমসেরনগর) গ্রামের ইছরাইল আলীর পুত্র সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান (২৬)। আসামিদের মধ্যে আকবর হোসেন ভূঁইয়া, আশেকে এলাহী, টিটু চন্দ্র ও হারুনুর রশিদ সরাসরি রায়হান হত্যাকান্ডে অংশ নেয়। হাসান উদ্দিন ও আব্দুল্লাহ আল নোমান দারোগা আকবরকে ভারতে পালিয়ে যেতে সহায়তাসহ আলামত নষ্ট করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

২০২০ সালের ১০ অক্টোবর দিবাগত রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হান আহমদকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে আনে পুলিশ। সকাল ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে রায়হানকে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয়। ৬টা ৪০ মিনিটে ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয় এবং ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যান রায়হান আহমদ। নিহত রায়হান আখালিয়ার নেহারিপাড়ার বাসিন্দা।

ওই দিনই ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ দাফন করা হয়। পরে ১৫ অক্টোবর কবর থেকে রায়হানের লাশ উত্তোলন করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। অবর্ণনীয় নির্যাতনে রায়হানের হাতের দু’টি আঙুলের নখ তুলে ফেলে এসআই আকবর। রাতভর নির্যাতনে রায়হানের শরীরে ময়নাতদন্তে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৪টি আঘাত ছিল গুরুতর। নির্যাতনের সময় রায়হানের আর্তচিৎকারে ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী কুদরত উল্লা রেস্ট হাউসের বর্ডারদেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতকদের গ্রেফতারের দাবিতে দলমত নির্বিশেষে সিলেটবাসী আন্দোলনে নামেন। সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, মিছিল-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। বৃহত্তর আখালিয়াবাসী গড়ে তুলেন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন।

এদিকে, রায়হান হত্যাকান্ডের পর এ ঘটনায় পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রীর করা মামলার পর মহানগর পুলিশের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে ফাঁড়িতে নিয়ে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা পায়। ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর কনস্টেবল হারুনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। তবে প্রধান অভিযুক্ত আকবর ঘটনার পর ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান। পরে ৯ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।