লোকবল সংকটে ধুঁকছে সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ

লোকবল সংকটে ধুঁকছে সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ

আনাস হাবিব কলিন্স:
লোকবল সংকটে ধুঁকছে সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। অধ্যক্ষসহ শিক্ষকের দশটি পদ শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। কর্মচারীর সৃষ্ট পদ ২৩টির মধ্যে ২০টি পদই খালি। কলেজের নিজস্ব গাড়ি থাকলেও ড্রাইভারের অভাবে পাঁচ বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে সেটি। এতে খুঁড়িয়ে চলছে প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরির প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক কার্যক্রম।

এ ব্যাপারে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চৌধুরী মামুন আকবর জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় শিক্ষা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেও কোন সুফল পাচ্ছেন না।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণের এমন শূন্যতা সিলেট অঞ্চলের শিক্ষা কার্যক্রমকে পিছিয়ে রাখবে। যুগোপযোগী শিক্ষায় এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দ্রুত হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মন্তব্য করেন।

উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষক তৈরির উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০০৫ সালে নগরীর পূর্ব শাহী ঈদগাহে তিন একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। আনুষ্ঠানিকভাবে এ কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার মরহুম হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী। শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য সিলেট বিভাগে এটিই একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান। এখানে বিএড ও এমএড কোর্স পরিচালিত হয় এক বছর মেয়াদে। আবার চার বছর মেয়াদী বিএড (অনার্স) কোর্সের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। এছাড়া, হাইস্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের চাকুরিকালীন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে হয়ে থাকে।

এই কলেজে একশ’ সিটের পুরুষ ছাত্রাবাস এবং পৃথক একশ’ সিটের মহিলা ছাত্রাবাস থাকলেও ছাত্রাবাসের জন্য কোন কর্মচারী নেই। যার কারণে ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীরা কর্মচারী ও বাবুর্চির খরচ নিজেরাই বহন করেন। হোস্টেল প্যাটার্নে কোন কর্মচারীর পদ রাখা হয়নি বলে জানিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। সেই সাথে শিক্ষকদের ডরমেটরি এবং কর্মচারী কোয়ার্টার না থাকা সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বড় সমস্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

কলেজ সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী বিএড কোর্স সম্পন্ন করেছেন। যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক। আবার একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১৫ সাল থেকে চার বছর মেয়াদী শিক্ষা বিজ্ঞানে বিএড (অনার্স) কোর্স সম্পন্ন করেছেন প্রায় ৩শ’ জন শিক্ষার্থী।

২০১০ সাল থেকে সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএড কোর্স চালু হলে প্রতি বছর ৩শ’ জন শিক্ষার্থী ব্যাচেলর অব এডুকেশন বিএড সম্পন্ন করছেন। সেই সাথে ২০১৫ সালে এই কলেজে শুরু হয় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছর মেয়াদী এমএড কোর্স। গত ২৯ অক্টোবর বাউবি’র এমএড প্রোগ্রাম ২০২০-২১ (২০২০) ব্যাচের প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এডুকেশনের সাবেক ডীন ড. সুনিল কান্তি দে বলেন, সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ স্টাডি সেন্টারের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে এমএড প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীরা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অবকাঠামোগত সুবিধা থাকলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত বিএড কোর্সে তিনশ’ আসন পূরণ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বাউবি পারচালিত বিএড কোর্সে বেশি ঝুঁকছেন। এ বিষয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত বিএড কোর্স সম্পন্ন করতে নিয়মিত ক্লাস করার প্রয়োজন পড়ে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে দীর্ঘ ছুটি না দেয়ায় তারা বিকল্প হিসেবে বাউবি’কে বেছে নিচ্ছেন। তাছাড়া, কলেজের হোস্টেলে থাকতে গেলে হোস্টেলের বাবুর্চি, আয়ার খরচ শিক্ষার্থীদের বহন করতে হয় বিধায় তারা সপ্তাহে বন্ধের দিন শুক্রবারে ক্লাস হওয়ায় বাউবি’কে পছন্দের তালিকায় রাখছেন।

সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক পরিষদ’র সম্পাদক ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. দিদার চৌধুরী বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে পাঠদানসহ সার্বিক অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে এখানে শিক্ষকদের ডরমেটরি থাকা অত্যন্ত জরুরি।

সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চৌধুরী মামুন আকবর জানান, দেশের অন্যান্য সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে এটির আয়তন অনেক কম। এখানে অনার্সের শিক্ষার্থীদের কোন হোস্টেল নেই। সবগুলো শূন্য পদ পূরণ হলে কলেজের সার্বিক কার্যক্রম আরো গতিশীল হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর হায়াতুল ইসলাম আখঞ্জি বলেন, শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সরকারি এই শিক্ষক প্রশিক্ষণের এমন শূন্যতা গোটা শিক্ষা কার্যক্রমকে পিছিয়ে রাখবে। এ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর আব্দুল মান্নান খান জানান, বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় মন্ত্রণালয়সহ শিক্ষা অধিদপ্তরে অনেকবার যোগাযোগ করা হয়েছে। সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের দাবি পূরণের স্বপক্ষে তার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরির জন্য যা পড়ানো হয় তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষণ দক্ষতা, মাধ্যমিক শিক্ষা, শিক্ষাক্রম ও শিশুর ক্রম বিকাশ, শিখন, মূল্য যাছাই, প্রতিফলনমূলক অনুশীলন ইত্যাদি। এছাড়া, বাংলা, ব্যবসায় শিক্ষা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, কৃষি শিক্ষা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ অন্যান্য বিষয়ও পড়ানো হয়।