শাল্লার বহুল আলোচিত ইউএনও মুক্তাদির অবশেষে স্ট্যান্ড রিলিজ

শাল্লার বহুল আলোচিত ইউএনও মুক্তাদির অবশেষে স্ট্যান্ড রিলিজ

কাউসার চৌধুরী
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার বহুল আলোচিত নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আল মুক্তাদির হোসেনকে অবশেষে স্ট্যান্ডরিলিজ করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে দিরাই উপজেলার এ্যাসিল্যান্ড অরুপ রতন সিংহকে শাল্লার ইউএনও’র অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।
তার বিরুদ্ধে মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণে চরম অনিয়ম ও লুটপাট, গোপনে রাতের আঁধারে হাওর রক্ষা বাঁধের (পিআইসি) গঠনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গতরাত সাড়ে ১০ টায় সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন, ‘এটা তার স্বাভাবিক বদলি বলা যায়।বদলির আদেশ হয়ে আছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে রিলিজ করে দিরাই’র এ্যাসিল্যান্ডকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পিআইসি গঠন নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণের অনিয়মের বিষয়েও তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে অনিয়ম প্রমাণিত হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শাল্লা উপজেলায় হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে অনিয়ম হয়েছে বলে গত মঙ্গলবার উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত অভিযোগ দেন। আটগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম আজাদ, হবিবপুরের বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল, বাহাড়ার বিধান চন্দ্র চৌধুরী ও শাল্লা ইউপি চেয়ারম্যান জামান চৌধুরী এতে স্বাক্ষর করেন।
অভিযোগে বলা হয়, উপজেলার হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ বিষয়ে গত ১০ জানুয়ারি উপজেলা কমিটির সভা হয়। উপজেলা পরিষদের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত ওই সভায় তাঁরা জানতে পারেন বাঁধের কাজের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন আগেই গোপনে হয়ে গেছে। অথচ তাঁরা এ বিষয়ে কোনো কিছুই জানেন না। তারা ইউএনও মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ করেন। চেয়ারম্যানদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বিষয়টির তদন্ত করতে সুনামগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেনকে প্রধান এবং পাউবোর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের দু’জন প্রকৌশলীকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটির সদস্যরা অভিযোগের তদন্ত করতে সরেজমিনে শাল্লায় আসেন।তারা দিনভর অভিযোগকারীদের উপস্থিতিতে শাল্লা ইউএনও কার্যালয়ে স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য গ্রহণ করেন।জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, লোকজনের বক্তব্য গ্রহণ শেষ হওয়ার পর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে।তদন্ত আরও বাকি রয়েছে।
সূত্র জানায়, শাল্লা উপজেলায় এখন পর্যন্ত ১৩৮টি পিআইসি গঠন করা হয়েছে। এ জন্য প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ২৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এদিকে, ইউএনও আল মুক্তাদির হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়।তার বিরুদ্ধে মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পরও তিনি ছিলেন বহাল তবিয়তে।
ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ পেয়ে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরকে সাথে নিয়ে শাল্লার সংশ্লি¬ষ্ট এলাকাসমূহ পরিদর্শন করেন। গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে ৩ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও ২০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাথে নিয়ে শাল্লায় তদন্তে যান তিনি । ২০ ফেব্রুয়ারি সিলেটের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান এনডিসি , জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকগণসহ ২৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওখানকার নির্মাণাধীন প্রত্যেক ঘরে ঘরে যান। এরপর আরও দুই দফায় জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ ২৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাল্লা উপজেলায় সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করেন।
সর্বশেষ ১৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরেজমিনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনিয়ম যাচাই করেন।তাদের কাছে নানাবিধ ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ে। শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা সুবিধাভোগীদের নিকট দিতে বাধ্য করা হয়।
শাল্লা উপজেলার বাসিন্দা দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলার গোপালপুর গ্রামের ৩ পরিবারকে অবৈধ পন্থায় ঘর দেয়া হয়। শাল্লা উপজেলায় নির্মিত ৩টি গ্রামের ২৫টি ঘরে দেখা দেয় ফাটল। ঘর নির্মাণ কাজের শুরু থেকে নানাবিধ অনিয়মের কারণে এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত উপজেলা মৎস্য অফিসার মামুনুর রহমানকে বান্দরবনে বদলি করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মুক্তাদির হোসেনকে দেয়া হয় কারণ দর্শানোর নোটিশ। এরপরই দরিদ্র গৃহহীনদের পরিবহন খরচ বাবদ ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা উপকারভোগীদের নিকট ফেরত দেন ইউএনও আল-মুক্তাদির হোসেন । সরকারের নীতি উপেক্ষা করে প্রায় ২৫৭টি ঘর দেয়া হয়েছে রেকর্ডীয় জায়গায়।প্রকল্প এলাকার ঘরের কাজ শেষ হতে না হতেই বেশ কিছু ঘরে বড় বড় ফাটল দেখা দেয়। ব্যবহারের আগেই কোনো কোনো ঘরের রান্নাঘর ও বাথরুমের অংশ ধসে পড়ে। খসে পড়ে দরজা জানালাও। উপজেলার ভেড়াডহর, আটগাঁও, মুজিবনগর ,সেননগরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে এমন দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয়।ঠিকাদারদের পাওনা অর্থও পরিশোধ করেননি ইউএনও মুক্তাদির।এজন্যে ভুক্তভোগী ঠিকাদাররা সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারের নিকট লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।
অবশ্য ইউএনও আল মুক্তাদির হোসেন এসকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন পিআইসি গঠনে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি।হাওরে হাওরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে পিআইসি গঠন করেছেন। নীতিমালার বাইরে ইউপি চেয়ারম্যানদের কিছু তদবির ছিল,যেগুলো রাখতে পারেননি। এ কারণে চেয়ারম্যানরা অভিযোগ করেছেন।মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণে কোনো অনিয়ম করেননি বলে দাবি করেন স্ট্যান্ড রিলিজ হওয়া ইউএনও মুক্তাদির।