সরকারের ফাঁদে পা দেবে না বিএনপি

সরকারের ফাঁদে পা দেবে না বিএনপি

রয়েল ভিউ ডেস্ক: সরকারের ফাঁদে পা দেবে না রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবিতে অনড় থাকলেও নীরবে চলছে নির্বাচনী প্রস্তুতি। প্রস্তুতি হিসেবে সারা দেশের প্রতিটি আসনে জরিপ পরিচালনা করছে দলটি। দলীয় একটি পেশাজীবী সংগঠনের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীদের খোঁজে জরিপের প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। আন্দোলনের পাশাপাশি মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান এবং যোগাযোগ বাড়ানোসহ সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রার্থীরা নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান শক্ত করার জন্য চলমান কর্মসূচিতে আসনভিত্তিক সভা-সমাবেশকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা এই সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেব না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই বিএনপি দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে। নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় হলে নির্বাচনী প্রস্তুতি কোনো ব্যাপার নয়। জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের ফাঁদে পা না দিয়ে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় ভোট করতে আগ্রহী। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড তা নাকচ করে দিয়েছে। গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নিয়ে হাইকমান্ড থেকে বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের অধীনে ভোটে গেলে কোনো সুফল আসবে না। সরকারবিরোধী অবস্থানে থেকে আন্দোলন প্রক্রিয়ায় সংকটের সমাধান করতে হবে। দেশের বর্তমান যে অবস্থা তাতে ক্ষমতাসীনদের অধীনে আগামীতে ভোটে অংশ নিলে গত নির্বাচনের মতোই ফল হবে- যা বিএনপির জন্য কোনো ইতিবাচক কিছু হবে না। এ কারণে বিএনপি রাজপথে থাকার সিদ্ধান্তে একমত রয়েছে। তবে এত কিছুর মধ্যেও নীরবে নির্বাচনী প্রস্তুতি চলছে দলটিতে। এ জন্য বর্তমানে যেসব কর্মসূচি চলছে তাতে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা আসনভিত্তিক কর্মসূচিতেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। 

জানা গেছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিজেদের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সারা দেশের প্রতিটি আসনে জরিপ পরিচালনা করছে বিএনপি। এ জন্য দলীয় একটি পেশাজীবী সংগঠনের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীদের খোঁজে জরিপের প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। আগামী মাসের মধ্যে এই জরিপ শেষ হওয়ার কথা। আসনভিত্তিক নির্দিষ্ট ফরমে এই জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ব্যক্তিগত তথ্যের পাশাপাশি সাংগঠনিক পরিচিতি, বিগত দিনে মামলা-হামলার বিবরণ, আগের নির্বাচনে তার অবস্থান, নির্বাচনী ফলাফল, বিগত দিনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে বিদ্রোহ কিংবা সিদ্ধান্ত অমান্য করার ইতিহাস, আসনভিত্তিক অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা, ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে দল থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে যোগ্য ও ত্যাগীদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। যারা দলে ফিরে আসতে আবেদন করেছেন তাদের বেশির ভাগকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব নেতা দলে কোণঠাসা ছিলেন কিংবা নিষ্ক্রিয় তাদের সক্রিয় করা হচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও চালাচ্ছে বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে আন্দোলনের পাশাপাশি বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছে দলটি। এরই মধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। গত এক মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বাধীন দলীয় একটি প্রতিনিধি দল। এসব বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তুলে ধরার পাশাপাশি দেশের বিরোধী মতের লোকদের গুম, খুনসহ বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা। এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে এখন লন্ডন থেকে সরাসরি দেখভাল করছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ঢাকায় বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বিএনপি নেতারা। গত ২২ আগস্ট থেকে সারা দেশে সমাবেশ করছে বিএনপি। এসব সমাবেশে সরকারদলীয় লোক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, মামলা হামলা করে আন্দোলন দমানো যাবে না। কর্মসূচিতে নিজেদের আসন উদ্ধারের জন্য নেতা-কর্মীদের চাঙা রাখছেন সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, হাইকমান্ড বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে অনড় রয়েছে। শেষ পর্যন্ত দল নির্বাচনে না গেলে কিছু শীর্ষ নেতা ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে বিএনপি নেতাদের এমন একটি তালিকা হাইকমান্ডের কাছে রয়েছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দল। আগামীর আন্দোলন, সাংগঠনিক কার্যক্রম, নির্বাচন সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে তাদের।

২২ দল নিয়ে আন্দোলন : নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আদায়ে ২২ দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে যাচ্ছে বিএনপি। এ জন্য রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত। দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে এ রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে ও পরের দুই পর্বে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর আগামী মাসের মাঝামাঝি দেশবাসীর সামনে এ রূপরেখা উপস্থাপন করবে বিএনপি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকার হটানোর যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একটা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করছি এবং দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেওয়া হয়েছে। অতিদ্রুত এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা জাতির সামনে আসব। রূপরেখায় কী থাকবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, একটা সুষ্ঠু-অবাধ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। এই সংসদ বাতিল করতে হবে এবং একটা নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, যাদের নেতৃত্বে নতুন একটা নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। তারা সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সব ভোটার যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এটাই আমাদের প্রধান বিষয়।

সূত্র জানায়, যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ডান-বাম-ইসলামী ২২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে বিএনপি। ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি দলসহ নবগঠিত গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত সাতটি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে তারা। দল সাতটি হলো- আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে নাগরিক ঐক্য, সাইফুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বে গণসংহতি আন্দোলন, ড. রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বে গণ অধিকার পরিষদ, রফিকুল ইসলাম বাবলুর নেতৃত্বে ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও হাসনাত কাইয়ুমের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।

এ ছাড়াও কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ লেবার পার্টি (একাংশ), মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ-ভাসানী (একাংশ), ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি-এনপিপি (একাংশ) ও খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা (একাংশ), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএলের সংলাপ করে বিএনপি। সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তার অধিকাংশই বিএনপির রূপরেখায় স্থান পেয়েছে। বিএনপির চিন্তার সঙ্গে সমমনা ওই সব দলের পরিকল্পনাও প্রায় একই হওয়ায় রূপরেখা নিয়ে মতপার্থক্য হবে না। বিএনপির পক্ষ থেকে দলীয় পরিকল্পনা ঘোষণার পরই দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের সংলাপ শুরু হবে। ওই সংলাপে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি যৌথভাবেও ঘোষণা হতে পারে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, দেশে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে, তা একক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর পক্ষে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সংস্কারসহ নতুন করে রাষ্ট্রকে বিনির্মাণ করা। এ জন্য সব গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। তারা বিএনপির সঙ্গে প্রাথমিক সংলাপে তাদের দলীয় ও গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেছেন। বিএনপির পরিকল্পনা দেখে পরবর্তী আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।