সিলেটে বিএনপি’র দায়িত্ব নিতে চান মেয়র আরিফ

সিলেটে বিএনপি’র দায়িত্ব নিতে চান মেয়র আরিফ

ডেস্ক রিপোর্ট:
এবার সিলেট বিএনপিতে দায়িত্ব নিতে চান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সাইড লাইনে রাখা হয়েছে তাকে। সিলেট বিএনপি’র বঞ্চিত অংশের নেতা তিনি। ঘরহারা নেতাদের নিজের কাছে দিয়েছেন ঠাঁই। এতে করে ব্যালেন্সও তৈরি হয়েছে সিলেট বিএনপিতে। সিলেটে দুই ভাগে বিভক্ত দল। পদবি পাওয়া নেতারা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের গ্রুপে। আর বঞ্চিতরা মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর গ্রুপে।

গত ক’বছর ধরে এভাবেই টানাপড়েনে চলছে সিলেট বিএনপি। কিন্তু হঠাৎ নড়েচড়ে বসেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এবার আর বঞ্চিত নয়, দলের কর্তৃত্ব নিতে নেমেছেন লড়াইয়ে। সরাসরি ভোটযুদ্ধ। ২১শে মার্চ হবে জেলা বিএনপি’র কাউন্সিল। আর এতে সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছেন বঞ্চিত নেতাদের নেতা আরিফ নিজেই।

এর আগে অবশ্য সিলেটের সিনিয়র নেতা আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে বাজি ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হিসাব মিলেনি। ফলে আব্দুর রাজ্জাককে বসিয়ে নিজেই ঘোষণা দিয়ে সভাপতি পদে মাঠে নামলেন। সতর্ক অন্যরা। বলতে গেলে তারাও কোমর বেঁধে মাঠে রয়েছেন। ম্যাজিক ম্যান আরিফুল হক চৌধুরী। নিজের দল ক্ষমতায় নেই ১৪ বছর। ১২ বছর ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে। এরপরও ৯ বছর ধরে সিলেট নগরের কর্তৃত্ব তার হাতেই। রাজনীতিবিদরাই বলেন- আরিফ খাদের কিনার থেকে ক্ষমতার মসনদে বসা এক নেতা। রাজনীতি তার কাছে জুয়ার মতোই। হঠাৎই নামেন, জয় করে ফিরেন ঘরে।

এমন কথা কেবল সিলেটের আরিফের বেলায়ই প্রযোজ্য। ওয়ান ইলেভেনে জীবন নিয়ে শঙ্কা ছিল। বিএনপি’র জমানায় ছিলেন সিলেট-১ আসনের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে কর্তৃত্ব খাটিয়েছিলেন। সে কারণে ওয়ান ইলেভেনে তার উপর দিয়ে গেছে সেই ধকল। ২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকার এলো ক্ষমতায়। হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা মামলার আসামি হন। পরবর্তীতে সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ওপর বোমা হামলা মামলার আসামি হন তিনি। এসব মামলায় কারাবরণ করেছেন। অসুস্থতায় কাবু ছিলেন। চেয়ারে বসেই আদালতে যাওয়া-আসা করতেন।

সিলেটে আরিফ যুগের অবসান- সেটি অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন। সেই আরিফ হঠাৎ করেই ২০১৩ সালে হলেন মাঠে সরব। নামেন মেয়র পদে নির্বাচনে। অনেক জল্পনা, আলোচনা তাকে নিয়ে। হাওয়া কোনো ভাবেই তাকে সমর্থন করছিলো না। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাঁদরেল রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। তখন ভোটের মাঠে কামরানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। আরিফ নিলেন চ্যালেঞ্জ। বিএনপি’র সমর্থনও পান তিনি। নির্বাচনে নেমেই তিনি বাজিমাত করেন। কামরান পরাজিত হলেন তার কাছে। নগর ভবনের মসনদ পেলেন আরিফ। সিলেট বিএনপি’র দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল এটি। আরিফ তা পূরণ করলেন। মেয়র হয়েও ছিলেন কারাগারে। জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে মেয়রের চেয়ারে বসেন।

সিলেটে উন্নয়নের নতুন ফর্মুলায় নিজেকে মেলে ধরলেন। এতে এলো সফলতা। ২০১৮ সালে একই ভাবে সিটি নির্বাচন। এবার নিজের দল বিএনপি তার পাশে। মার্কাও ধানের শীষ। প্রতিদ্বন্দ্বী কামরান। মার্কা নৌকা। প্রথম দফা ভোটের হিসেবেও প্যাঁচ। স্থগিত হওয়া কেন্দ্রগুলোতে হলো পুনঃভোট। এতে জয় আরিফের। এবার নগর মসনদে বসা আরিফ আরও শক্তিশালী। উন্নয়ন করাচ্ছেন এক হাতে। টাকাও মিলছে সরকার থেকে। কিন্তু এক যুগের বেশি সময় থেকে বিএনপিতে সাইড লাইনে আরিফ। এখন তিনি সিলেট বিএনপি’র অন্যতম শীর্ষ নেতাও। কেন্দ্রের সদস্য পদে আছেন। এই পদই তার একমাত্র ভরসা। কৃষকদলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। সিলেট বিএনপি’র নীতিনির্ধারক মহলে নেই তার অবস্থান। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরই এখন সিলেট বিএনপিকে চালাচ্ছেন।

তার হাতে রয়েছে মূল কর্তৃত্ব। ফলে বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আরিফ কোণঠাসা। এরই মধ্যে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, বিএনপি’র কমিটি পুনর্গঠন হয়েছে। আরিফ নীরবই থেকেছেন। দল গোছাতে গেলে বিদ্রোহ থাকেই। ফলে যেসব কমিটি সিলেটে ঘোষিত হয়েছে; সেখান থেকে অনেক সিনিয়র ও যোগ্য নেতারা বাদ পড়েন। তারা বিদ্রোহী হয়েছিলেন। প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছিলেন। এ নিয়ে বিএনপি’র অভ্যন্তরে নানা সংকট দেখা দেয়। এই অবস্থায় সিলেটে অবস্থান করা দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে প্রয়াত এম এ হক, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী একত্রে বসে এই সংকটের সমাধান বের করেন। বঞ্চিত, ক্ষুব্ধ নেতাদের ক্ষোভ প্রশমনে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

এতে করে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী হয়ে উঠেন ফ্যাক্টর। এম এ হকের মৃত্যুর পর বঞ্চিত অংশের কর্তৃত্ব পুরোপুরি তার হাতেই চলে আসে। সামনে জেলা বিএনপি’র সম্মেলন। জেলার সভাপতি হচ্ছেন সিলেট বিএনপি’র অন্যতম অভিভাবক। এই অভিভাবক হতেই আরিফ এবার মাঠে নেমেছেন বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ নেতারা। তারা বলেন সিলেট বিএনপিতে কর্তৃত্ব নিতেই আরিফুল হক চৌধুরী কাউন্সিলে প্রার্থী হয়েছেন। এতে পদে পদে আসছে বাধা। তাদের দাবি- সভাপতি প্রার্থী হওয়ার পর নানা ভাবে বিধিনিষেধ দিয়ে প্রার্থীদের চিন্তিত করে তোলা হচ্ছে। ২০১৬ সালের জেলা কাউন্সিলে ভোট দিয়েছিলেন ইউনিটের ৫ পদের নেতারা। সর্বমোট ভোটার ছিলেন একশ’র নিচে। এবার এখন পর্যন্ত ভোটার ১৮১৮ জন।

ফলে বিশাল সংখ্যক ভোটারের কাছে ছুটতে হচ্ছে প্রার্থীদের। কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না বলে অপপ্রচার করা হয়েছিলো। এসব মোকাবিলা করে প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে চলতে হচ্ছে। তবে আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, যেভাবে কাউন্সিল হোক তিনি প্রার্থী। সিলেটে দলের ভেতরে সমতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ফিরে আনতে প্রার্থী হয়েছেন। তবে ভোটার বেশি হওয়ায় প্রার্থীদের কষ্ট হচ্ছে। এরপরও দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তারা ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন। এদিকে গতকাল জেলা বিএনপি’র সম্মেলন ও কাউন্সিলের প্রস্তুতি সভা হয়েছে। এ সভায় ভোটার নয়, প্রার্থী সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কেবল নির্বাচনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন নেতারা।

 জরুরি সভা: বিএনপি’র কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেছেন, দলের সকল স্তরে কাউন্সিলের মাধ্যমে যোগ্য কর্মীবান্ধব সক্রিয় নেতারা নেতৃত্বে আসছেন। এতে দলের কার্যক্রম শক্তিশালী হয় এবং দলের ভেতরে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। বুধবার আসন্ন জেলা কাউন্সিলকে সামনে রেখে সিলেট জেলা বিএনপি’র জরুরি সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি কথা বলেন। জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আসন্ন কাউন্সিলকে সফল করতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। কাউন্সিলকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়। সভায় জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্যবৃন্দ ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন এবং কেন্দ্রীয় সিলেট বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি কলিম উদ্দিন মিলন।

সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আশিক উদ্দিন চৌধুরী, আলী আহমদ, আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, ফখরুল ইসলাম ফারুক, মাহবুবুর রব চৌধুরী ফয়সল, মামুনুর রশীদ মামুন, ইশতিয়াক আহমদ সিদ্দিকী, এডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী, এডভোকেট হাসান আহমদ পাটোয়ারী রিপন, আব্দুল আহাদ খান জামাল। সভায় সম্মেলন ও কাউন্সিলের জন্য ৫টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়।