সড়ক’র নারী ট্রাফিকরা বিড়ম্বনা শিকার হচ্ছে প্রাকৃতিক ডাকের!

সড়ক’র নারী ট্রাফিকরা বিড়ম্বনা শিকার হচ্ছে প্রাকৃতিক ডাকের!

রয়েল ভিউ ডেস্ক :
দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণ এখন সব খানে। সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের মতো কঠিন কাজেও নিয়মিত হয়ে উঠেছে তাদের অংশগ্রহণ। খোলা আকাশের নিচে, রোদ-বৃষ্টি, ধুলা-বালি সয়ে হাজারো গাড়িঘোড়ার শৃঙ্খলা সমলাতে নারী সার্জেন্টরা কতটা পারবেন, এ নিয়ে শুরুতে সংশয় ছিল। তবে তা উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের তারা প্রমাণ করেছেন নিষ্ঠাবান, দক্ষ আর মানবিক কর্মী হিসেবে। কিন্তু এই উন্মুক্ত কর্মক্ষেত্রে তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা তৈরি হয়েছে কি না, এ নিয়ে আছে প্রশ্ন।

বিশেষ করে সড়কে আট ঘণ্টা টানা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি নারী সার্জেন্টদের জন্য। ফলে প্রতিদিন বিড়ম্বনায় পড়ছেন তারা। পুরুষকর্মীরা আশপাশের মসজিদ বা মার্কেটে যেতে পারলেও নারী সার্জেন্টদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বারবার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানোর পর কিছুটা সুরাহা হতে শুরু করেছে। তবে পুরোপুরি প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ।

ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দুই শিফটে পুরুষ পুলিশের পাশাপাশি কাজ করেন নারী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। তবে রাত ১১টার পর নারী সদস্যদের দায়িত্ব দেয়া হয় না সাধারণত।

নারী সার্জেন্টরা বলছেন, আট ঘণ্টা কাজ করতে গিয়ে দু-তিনবার টয়লেটে যাওয়ার চাপ তৈরি হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ট্রাফিক পয়েন্টে কোনো টয়লেট নেই। প্রাকৃতিক কাজটি সারতে আশপাশের বাসের কাউন্টার, সরকারি অফিস, বড় বিপণিবিতান বা বাসাবাড়ির দারোয়ানের টয়লেটে যেতে হয়। বিশেষ করে বাসাবাড়িতে ঢুকতে হয় অনুনয়-বিনয় করে।

নারী সার্জেন্ট লিমা চিশিম। ময়মনসিংহের এই তরুণী ইডেন মহিলা কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ২০১৫ সালে যোগ দেন সার্জেন্ট হিসেবে। প্রশিক্ষণ শেষে কাজ শুরু করেন ডিএমপিতে। বর্তমানে তিনি ডিএমপির মোহাম্মদপুর বিভাগে কর্মরত। দেশের নারী সার্জেন্ট হিসেবে প্রথম ব্যাচের সদস্য তিনি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জানালেন, এই পেশায় আসার ইচ্ছা আগে থেকে ছিল না তার। তবু এলেন। মা সব সময় ভালো কিছু করার জন্য উৎসাহ দেন। বাবা তো আছেনই।

লিমা চিশিম বলেন, ‘রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারী হিসেবে কখনো কোনো প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হয়নি। বরং মনে হয়, আমরা আরও ভালো কাজ করি। গাড়ির চালক বা মালিকরা কখনো খারাপ ব্যবহার করে না।’ বরং অনেকে আইন ভেঙে কিছু করলে তখন তার কাছে এসে অনুতপ্ত হয়। এমন আর হবে না প্রতিশ্রুতি দেয়। এটা খুব ভালো লাগে তার।

নারী হিসেবে এই কঠোর কাজটি করতে গিয়ে প্রথম প্রথম একটু দুরূহ মনে হতো লিমা চিশমির। ধীরে ধীরে সবকিছু রপ্ত হয়ে গেছে। বলেন, ‘পরিশ্রমও সয়ে গেছে শরীর। সিনিয়র অফিসাররা সব সময় সাহায্য করেন। আর ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে সব সময় নারী হিসেবে উৎসাহ পাই।’

রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কাজ করতে যতটা না কষ্ট হয় তার চেয়ে বেশি বিব্রত বোধ করেন টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হলে। লিমা চিশিম বলেন, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে সারা দিন ডিউটি করতে হয় বলে ধুলাবালির কারণে প্রায় সময় সর্দিকাশি লাগে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের। এটা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে তাদের জন্য। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা পুলিশ বক্সগুলোতে টয়লেট নেই। বিশেষ করে নারী সদস্যদের জন্য এটা মহা বিড়ম্বনার। আজ একজনের টয়লেটে, কাল আরেকজনের টয়লেটে যেতে হয় প্রয়োজন সারার জন্য। যত অসুবিধা থাকুক, এর মধ্যেই আমাদের কাজ করতে হয়।’

পুলিশ বাহিনীতে নারী সার্জেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৪ সালে। সবশেষ সার্জেন্ট পদে নিয়োগের পরীক্ষায় অংশ নেন এক হাজার ৮৩৭ জন। এর মধ্যে নারী প্রার্থী ছিলেন ৪৬ জন। নিয়োগ পান ২৮ জন।

সার্জেন্ট ইসমত তারা তিথি। দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে বাহিনীতে যোগ দিয়ে এখন তিনি মোহাম্মদপুরে জোনে কর্মরত। তিনিও নারী ট্রাফিক সার্জেন্টের প্রথম ব্যাচের সদস্য। রাস্তায় ডিউটি করতে প্রথম দিকে অসুবিধা হলেও পরে সেটা সয়ে গেছে।

তবে টয়লেটের সমস্যাটি ভোগায় ইসমতকে। বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। দায়িত্ব পালনের জন্য সুবিধা হতো। সমস্যাটি আমাদের মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। স্যাররা বলেছেন, দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন।’

রমনা থানা, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, শেরেবাংলা নগর থানা, মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ, শ্যামলী এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের বুথগুলোতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা আছে কমই। কোনোটাতে নেই ফ্যান-লাইট পর্যন্ত। প্রচণ্ড দাবদাহ পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠতে হয় তাদের। তবে রাজধানীর বেশ কিছু পুলিশ বক্স গত বছর আধুনিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। যেমন- রাজধানীর ওয়ারী, যাত্রাবাড়ী ও পোস্তাগোলায় আধুনিক ট্রাফিক পুলিশ বক্স করা হয়েছে। সেখানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ছাড়াও উন্নত সব সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী সার্জেন্ট বলেন, ‘প্রথম তিন-চার মাস লজ্জায় টয়লেট ব্যবহার না করেই অনেক কষ্টে ডিউটি করেছি। পরে অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অফিস বা মার্কেটে যাওয়া শুরু করি এরপর। তবে শুক্র ও শনিবার অফিস ভবন বন্ধ থাকলে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়।’

‘অনেক সময় সিকিউরিটি গার্ডদের সহযোগিতা নিয়ে টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। আবার মাসের নির্ধারিত কয়েকটি দিন ঋতু চলাকালে মার্কেট কিংবা অন্য কোনো অফিসের টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে খুবই লজ্জায় পড়তে হয়। এসব কারণে নারী পুলিশের জন্য অবশ্যই নির্ধারিত টয়লেট থাকা দরকার।’

নারী সার্জেন্টদের এ সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে। তবে আমাদের যেসব পুলিশ বক্স আছে সেগুলো রাস্তার পাশে এবং সিটি করপোরেশনের জায়গায় তৈরি। করপোরেশনের সঙ্গে আমরা একটা সম্পর্ক তৈরি করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি। করপোরেশন আমাদের কিছু নতুন জায়গা দিয়েছে। সেসব জায়গায় নতুন ট্রাফিক বক্সগুলোতে নারী সার্জেন্ট ও বয়স্ক সদস্যদের বিষয় মাথায় রেখে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা আছে। বিশেষ করে শান্তিনগর ট্রাফিক বক্স, মতিঝিল ট্রাফিক বক্স, বিজয়স্মরণী বক্স সুন্দর করে গড়ে তোলা হয়েছে।’

নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত বক্স পর্যায়ক্রমে বাড়ছে এবং বাড়বেও বলে জানিয়ে অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) বলেন, ‘ট্রাফিক্স বক্স করতে বড় সমস্যা জায়গা না পাওয়া। আবার ব্যক্তিগত জায়গাতেও করা যায় না। আর যেখানে সেখানে বক্স করলেও তো হবে না। যেখান থেকে ট্রাফিক কন্টোল ভালো করা যায়, সেটাও একটা বিষয় থাকে। আমাদের সদস্যরা যাতে ভালো থাকে সেই বিবেচনা করে আমরা কাজ করছি।’

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘নারী সদস্যদের ডিউটি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাথরুম ও কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ-সুবিধা আছে এমন পয়েন্টই বেছে নেওয়া হয়, যাতে ডিউটিরত অবস্থায় তারা পেশাদারি বজায় রাখতে পারে। পাশাপাশি বয়স্ক পুরুষ সদস্য আছেন, তাদের বিষয় মাথায় রেখে আধুনিক ট্রাফিক পুলিশ বক্সের নকশা করা হয়েছে।’