হাওরে খাদ্য সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হাঁসের খামার, কমছে প্রাকৃতিক খাবার

হাওরে খাদ্য সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হাঁসের খামার, কমছে প্রাকৃতিক খাবার

আজমিরীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) থেকে সংবাদদাতা : রোদ তীব্রতা দখল করে ফেলেছে বোরো ধানের ক্ষেত আর জলাভূমির সীমানা। হঠাৎ প্যাক-প্যাক-প্যাক মৃদু শব্দে একদল হাঁস এগিয়ে আসছে। আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ছে তাদের শব্দতান। মনে হচ্ছে, এটি যেনো গৃহপালিত প্রাণীদের মিছিল । জমির আইল, জল জমে থাকা ডোবা-ছড়া ডিঙিয়ে তাদের সম্মিলিত গতি। জল ডিঙিয়ে ছুটছে হাঁসের দল । এ যেনো আবহমান বাংলার অপূর্ব প্রতিচ্ছবি। হাঁসের পাল যেদিকে যাচ্ছে তার পাশেই জমির ওপর হাঁসের মালিককে হঠাৎ দেখা গেল, মোবাইলফোনে কথা বলতে। হাত দিয়ে এগিয়ে আসার সংকেত পাঠানোর পরও তার নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। কিছু সময় গড়ালো। ততক্ষণে হাঁসের দল ধানক্ষেতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনই হাঁসের মালিককে দেখা গেল দৌঁড়ে এসে ধানক্ষেত থেকে বাঁক ঘুরিয়ে হাঁসের পানির দিকে নামিয়ে পুনরায় অপর দিকের জমিতে তুললেন। হাঁসগুলো দলকে শৃংখলার সঙ্গে মালিকের নির্দেশ মতোই এগিয়ে চললো। কাছে গিয়ে এর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, ধানক্ষেতে তাদের নামতে দিলেই ওরা পাকাধানগুলো নষ্ট করে ফেলবে। জমির মালিক এসে আমাকে নানান কটু কথা বলবে। আবার তাদের জলে বেশিক্ষণ নামার সুযোগ দিলেও ওরা খাবার কথা ভুলে গিয়ে গোসলে সময় নষ্ট করবে। তাই তাদের বেশিক্ষণ পানিতে থাকতে দেবো না। শুধু খালটুকু পেরুনো পর্যন্তই ওরা পানিতে থাকবে বলে জানান।
এই হাঁসের দলের মালিকের নাম সামছুল আলম। তিনি হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বদলপুর ইউনিয়নের হিলালপুর গ্রামের বাসিন্দা। ৭ বছর ধরে এই হাঁস পালন পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। ৭ বছর আগে তিনি ১ হাজার হাঁস দিয়ে হাঁস পালন শুরু করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন না থাকার কারণে প্রায় অর্ধেক হাঁস রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েন তিনি। অভিমানে ছেড়ে দেন হাঁসপালন। পরে ভালোবাসার টানে আবার শুরু করেন । হাঁস সম্পর্কে সামছুল  বলেন, আমি মোট ১৫শ’ হাঁসের ছানা দিয়ে এ বছর ওই খামারটি শুরু করি। নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখন মোট ৯১৫টি হাঁস রয়েছে। এখন এই বাচ্চাগুলোর বয়স চলছে আড়াই মাস। ডিম দিতে আরো তিন-চার মাস লাগতে পারে। হাঁস এমনিতে ৬ মাসে ডিম দেয়। তবে প্রাকৃতিক এবং পুষ্টিকর খাবার যদি খাওয়ার সুযোগ থাকে, তবে ৪ মাসেও ডিম দিয়ে থাকে।

প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাঁসের তাড়াতাড়ি ডিম দেওয়াটা নির্ভর করে তার খাদ্যের ওপর। এখন আমাদের হাওরে হাঁসের প্রাকৃতিক খাবারের তীব্র সংকট। মাটিতে এখন নানা ধরনের খাদ্য তৈরি হয় না। যেমন- শামুক, ব্যাঙ, জলের নানান পোকা, শালুক এসব এখন আগের মত হয় না। এসব প্রাকৃতিক খাবার খেলেই তাদের শরীরে অন্যরকম একটা শক্তি চলে আসে।  হাঁসের খামারের খরচ সম্পর্কে তিনি বলেন, ১৫শ’ হাঁসের বাচ্চা ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ৫০ হাজার টাকা । ১৫ বস্তায় প্রায় ৪২ হাজার টাকার খাদ্য খাওয়াচ্ছি তাদের এ পর্যন্ত। এ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আগামী আষাঢ় মাস থেকে ডিম পাওয়া যেতে পারে। আমার ৮১৫টি মাদি হাঁসগুলো যদি দুই মাস টানা ডিম দেয় তাহলে লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা রয়েছে। কম করে হলেও দৈনিক ৫শ ডিমে দৈনিক ৫ হাজার টাকা করে মাসিক হিসাব দাঁড়ায় দেড় লাখ টাকা।

আগে একটা সময় ছিল ১৫শ’ বাচ্চা কিনে আনলে ১৫শ বাচ্চাই টিকেছে, মরেনি একটিও। এখন শামুক খেতে না পারার কারণে বাচ্চা দুর্বল হয়ে মারা যায়। গত দুই বছর ধরে হাঁস পালনে তেমন একটা সফলতা আসছে না। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে ১০/১৫ হাজার টাকা থাকে। কিন্তু বিগত বছর গুলোতে হাঁস পালন মৌসুমে কয়েক লাখ টাকা করে লাভ হয়েছিল।
চলতি মৌসুমে এই পর্যন্ত প্রায় ৭০ মণ ধান কিনে খাওয়াইতে হয়েছে হাঁসদের। ৭০ মণ ধানের দাম প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এই হাওরে যদি পর্যাপ্ত পানি থাকতো তাহলে আমার অতিরিক্ত এই ৫০ হাজার টাকা খরচ করা লাগতো না। হাওরের প্রাকৃতিক আমিষ এবং শর্করা জাতীয় খাবার থেকেই হাঁসগুলো দিব্বি সুস্থ-সবল থাকতো বলে জানান ওই হাঁস চাষি সামছুল আলম।