৫৭ বছর পর জলপাইগুড়ি-ঢাকা রুটে ‘মিতালী’

৫৭ বছর পর জলপাইগুড়ি-ঢাকা রুটে ‘মিতালী’

রয়েল ভিউ ডেস্ক:
অবশেষে পশ্চিমবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ির সঙ্গে রেলপথে যোগাযোগ শুরু হলো ঢাকার। আর এতে দীর্ঘ ৫৭ বছর পর এই রেলপথে ট্রেন চলা দেখলো দুই বাংলার মানুষ। 

দুই দেশের নাগরিকদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে বুধবার সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে নির্ধারিত সময়ে চাকা গড়ায় বহুল প্রতীক্ষিত মিতালী এক্সপ্রেসের। সবুজ পতাকা দেখিয়ে ভার্চুয়ালি এই মিতালী এক্সপ্রেসের শুভ উদ্বোধন করেন ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ এবং বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। 
 
এ সময় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন ভারতের লোকসভার সংসদ সদস্য জয়ন্ত কুমার রায়, সংসদ সদস্য রাজু বিস্ত, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়ক শিখা চ্যাটার্জী, বিধায়ক শংকর ঘোষ , দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরান, বাংলাদেশ রেলওয়ে বোর্ড অপারেশনসের এডিজি সরদার শাহাদাত আলী , ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান বি কে ত্রিপাঠীসহ ভারতীয় রেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পতাকা উত্তোলনের পর ট্রেনটি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়।

এদিন দিল্লি থেকে ভার্চুয়ালি ভারতীয় রেলমন্ত্রী বৈষ্ণব বলেন, ভারতীয় রেলের কাছে খুবই একটা খুশির মুহূর্ত। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক তা দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের দুই দেশের মধ্যে ভাগাভাগি করা ঐতিহ্যে। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এই এক্সপ্রেস ট্রেনটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়াবে। 

তিনি বলেন, গত গত কয়েক বছর আগেও দুই দেশের মধ্যে মাত্র ৭০০ মালবাহী ট্রেন যাতায়াত করত, সেখানে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রায় ১৬০০ এর কাছাকাছি হয়েছে। 

ভারতীয় রেলমন্ত্রী আরও বলেন, গতকাল বাংলাদেশের রেলমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকালে সুজন জানান সেদেশের রেলের ব্রডগেজ, রেলের বৈদ্যুতিককরণ, সিঙ্গেল থেকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হবে - আমি তার প্রশংসা করছি এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। আর এই কাজে প্রয়োজনে বড় পাহাড়ের মতো বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো এবং সব রকম সহায়তা করতে প্রস্তুত ভারত। 

এ সময় তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমরা কখনই আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে পিছপা হব না।

অন্যদিকে বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। একাত্তরের যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে সেক্টর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাহলো রেল। রেলের বড় বড় ব্রিজ, রেল লাইন, কারখানাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এই বিধ্বস্ত রেলকে গড়ে তোলার জন্য জাতির জনক কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেটা ভারতের সহযোগিতায় আমাদের রেল ব্যবস্থাকে আমরা পুনর্গঠন করেছিলাম। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা রেল ব্যবস্থাকে সবসময় অবজ্ঞা করেছে। এর প্রতি কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। 

তিনি বলেন, এই ধ্বংসপ্রাপ্ত রেল ব্যবস্থাকে গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১১ সালে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছি অবিভক্ত ভারতে যে রেল লাইনগুলো ছিল, যে রেল পরিষেবা ছিল সেগুলোকে পুনরায় চালু করার জন্য আমরা কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে এর আগে যে ক'টি জায়গা দিয়ে রেল যোগাযোগ ছিল সেগুলি পুনঃস্থাপন করতে।

তিনি আরও বলেন, সপ্তাহে দু'দিন এই মিতালী ট্রেন চালু থাকবে। কিন্তু পরবর্তীতে যদি সম্ভব হয় তবে সপ্তাহে পাঁচদিন চালানোর জন্য ভারতের কাছ প্রস্তাব রাখব। কারণ এই পথটি বাংলাদেশের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। 

১৮ জন যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে
এদিকে ভারতীয় রেলের সিপিআরও সব্যসাচী দে বলেন, এদিন উদ্বোধনের পর মাত্র ১৮ জন যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। তবে দিন দিন এই যাত্রীসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়বে বলে আশাবাদী দুই দেশের রেলমন্ত্রী।

 মিতালী এক্সপ্রেস নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ছাড়বে রোববার ও বুধবার এবং ঢাকা থেকে ছাড়বে সোমবার ও বৃহস্পতিবার। ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য পাসপোর্ট ভিসা আবশ্যক। তবে এখনই ট্রেনে খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না প্যাসেঞ্জারদের জন্য। 

মিতালী স্পেশাল ভারতীয় টিকিট পরীক্ষক শফিউল্লাহ খান বলেন, টিকিট পরীক্ষা ছাড়া কাস্টম ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স পরীক্ষা করা এতদিন আমাদের কাজের মধ্যে পড়তো না। এখন থেকে টিকিটের পাশাপাশি এটাও আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এটা আমাদের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। 

উত্তরবঙ্গ রেলের কর্মকর্তা অলক কুমার বলেন, ভারত বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তৃতীয় যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হলো আজ।

মৈত্রী, বন্ধনের পর এবার মিতালী এক্সপ্রেস দুই বাংলার মধ্যে চলাচল করবে। এই ট্রেন পরিষেবা চালু পর্যটন ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে বলে আশাবাদী উত্তরবঙ্গের পর্যটন শিল্প মহল। সেই সঙ্গে বাণিজ্যিক দিক থেকেও উত্তরবঙ্গের গুরুত্ব বাড়বে বলে আশাবাদী অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী মহল। 

শিলিগুড়ি বিজেপি বিধায়ক শংকর ঘোষ বলেন, পর্যটন এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মিতালী এক্সপ্রেস দুই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বুধবারের ১৮ যাত্রীর মধ্যে চারজন ছিলেন ভারতীয়। বাকি ১৪ জন বাংলাদেশি নাগরিক।  তাদের মধ্যে একজন আবেশ সিদ্দিকী টিটো বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সেরা উদ্যোগের একটি মিতালী এক্সপ্রেস।  এতে যাতায়াতের সময় কমে আসবে অনেক। যাত্রীদের হয়রানি কমবে অনেকটাই। 

ভারতের এনজেপি স্টেশন থেকে বাংলাদেশের ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত যাবে এই ট্রেন। অপারেশনাল স্টপেজ ছাড়া বিরামহীনভাবে চলবে ট্রেন। নিশ্চিত করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ট্রেনটির এসি কেবিন বার্থের ভাড়া ৪৯০৫ টাকা, এসি কেবিন চেয়ারকোচের ভাড়া ৩৮০৫ টাকা, এসি চেয়ারকোচের ভাড়া ২৭০৭ টাকা। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ঢাকা রেল স্টেশনের দূরত্ব ৫৯৫ কিলোমিটার, যার মধ্যে ৬৯ কিলোমিটার ভারত ভূখণ্ডে পড়ে। ভারতের দিকে সীমান্তের শেষ সীমান্ত স্টেশন হলদিবাড়ি। বাংলাদেশের দিকে প্রথম সীমান্ত স্টেশান চিলাহাটি।