একজন শিক্ষকের উপলব্ধি

একজন শিক্ষকের উপলব্ধি

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

২০২০-এর ১০ জানুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা। তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। দর্শক সারিতে বসে অবাক হয়ে দেখছিলাম দেশের দ-মু-ের কর্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি অসম্ভব সম্মানের সঙ্গে তাঁর শিক্ষক, মুজিববর্ষ উদ্যাপনের জাতীয় কমিটির প্রধান, জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত রফিকুল ইসলাম স্যারকে হাত ধরে পোডিয়ামের দিকে নিয়ে এগোচ্ছেন আনুষ্ঠানিকতাগুলোর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য।

ইদানীং ফেসবুকে ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদের একটি ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছে। ১৯৯৪ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলেন ওমানে। সে সময় সুলতান কাবুস সমস্ত প্রটোকল ভেঙ্গে নিজে বিমানে উঠে গিয়ে রাষ্ট্রপতি শর্মাকে স্বাগত জানান। শুধু তাই নয়, তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে তার জন্য নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাকে। সুলতান কাবুস পরে জানিয়েছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি শর্মাকে নন, প্রটোকল ভেঙ্গে সম্মান জানিয়েছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে। কারণ, পুনেতে লেখাপড়া করার সময় রাষ্ট্রপতি শর্মা ছিলেন তাঁর শিক্ষক।
 
হালে যখন দেশজুড়ে শিক্ষক পেটানোর ধুম চলছে, তখন শিক্ষক হিসেবে প্রতিটি ঘটনায় লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়েছে। হৃদয় ম-লকে যখন মানিকগঞ্জে কারাগারে পাঠানো হলো মনে হচ্ছিল, হ্যান্ডকাফটা হৃদয়ের নয়, পরানো হয়েছে আমার হাতেই। নড়াইলে যখন অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা, তখন সে মালা কি পরেনি আমাদের মতো শিক্ষকদের গলাতেও? গায়ে লেগেছে, মুখ খুলিনি। মুখ খুলিনি কারণ, সাভারে যখন স্টাম্পের আঘাতে প্রকাশ্যে লুটিয়ে পড়ে অসহায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের নিথর দেহ, তখন ভয় হয় মুখ খুললে আমার মতো ছাপোষা শিক্ষকের ওমন করুণ পরিণতি হতে কতক্ষণ? এ কারণেই কলম ধরিনি যখন মৌলবাদী হামলা হলো উত্তরায় সহযোদ্ধা শিক্ষকের বাসাতেও। সবশেষে এই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন একজন সংসদ সদস্য। স্থানীয় ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে কিল-ঘুষি-লাথি এমনকি হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে নিজের বীরত্ব জাহির করেছেন উত্তরবঙ্গের এই জনপ্রতিনিধি।

যে নেত্রী তাঁর শিক্ষককে মাথায় করে রাখেন, তাঁর দয়ায় মনোনীত হয়ে জনপ্রতিনিধি হয়ে বসা কোন ব্যক্তির এমন আচরণের পর কলমটা আর পকেটে গুঁজে রাখতে সায় দিল না মনটা। সবাই অবশ্য আমার মতো ‘চোখ বুজে খারাপ কিছু দেখব না টাইপের’ নন। অনেক আগেই এ নিয়ে কলাম লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। জাতীয় একটি দৈনিকে চোখে পড়েছে শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফের লেখা কলামটিও। চোখে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির একটি প্রতিবাদ লিপি। লিখেছেন হয়ত আরও অনেকেই। হয়ত প্রতিবাদীও হয়েছেন আরও অনেকেই। হয়ত চোখে পড়েনি আমার। তারপরও মনে হয়, আরও বেশি লেখা ছাপার কথা ছিল। দেশজুড়ে বয়ে যাওয়ার কথা ছিল প্রতিবাদের ঝড়। বাস্তবে তেমনটি হয়নি। তাতে অবশ্য বয়েই গেছে।

‘মার খেয়েছে শিক্ষক, গেছে জেলে, মরেছে মার খেয়ে- তাতে আমার পূর্বপুরুষের কি?’- এই ভেবে বেশ তৃপ্তিতেই ঢেকুর গিলেছেন একদল। আরেক দল আছেন আমার মতো, যাদের গায়ে লেগেছে প্রচণ্ড, কিন্তু মুখ খোলেননি। ধরেননি কলমও। ভেবেছেন পাছে গায়ে এসে পড়ে!

এমনটাই ভেবেছিলেন অনেকেই একাত্তরেও। কিন্তু ভাবেননি সবাই। ভাবেননি ডাঃ আলীম চৌধুরী, ডাঃ ফজলে রাব্বি, মুনীর চৌধুরী আর এমনি অনেক শিক্ষকই। দেশটাকে দশের জন্য দেশের মতো দেশ বানানোর তাগিদে তারা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে পিছ-পা হননি। অথচ পঁচাত্তরের পর যখন থমকে গেল তাদের হত্যাকারীদের বিচারের প্রক্রিয়া, বরং খুনীই হয়ে বসল শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, তখন সেদিনও বেশিরভাগ শিক্ষকই ‘আমার পূর্বপুরুষের কি’ কিংবা ‘পাছে গায়ে এসে পড়ে’- এই চিন্তায় স্রোতের বিপক্ষে না দাঁড়িয়ে বরং গড্ডালিকা প্রবাহেই পাল তুলেছিলেন। সেদিন তারা তেমনটি করেছিলেন বলেই আজ সংসদ সদস্য শিক্ষক পেটায় আর ছাত্র পিটিয়ে মারে শিক্ষককে।

শিক্ষক হিসেবে আমাদের জোট বেঁধে পথে নামতে হবে, হরতালে-বিক্ষোভে তাতাতে হবে রাজপথ, তেমনটা কখনই বলি না। কিন্তু আমাদের যেটুকু শক্তি বলায়, পড়ানোয় আর লেখনীতে, সেটুকুও যদি আমরা প্রয়োগ না করি, তবে শিক্ষক হয়ে নিজের সন্তানকে এই পেশায় আসতে আমরা যেমন আর উৎসাহিত করতে পারব না, তেমনি নিশ্চিত জেনে রাখুন, সামনে পায়ের নিচে আর শক্ত মাটিও থাকবে না।

আর পেশাজীবী হয়ে যে পেশার সম্মান আমরা সমুন্নত রাখতে পারি না, সেই পেশার চর্চা করে মাসের শেষে বেতন গোনা কিংবা নিজেদের নামের আগে-পিছে ভিসি-প্রোভিসি-চেয়ারম্যান ইত্যাদি তকমা যোগ দেয়ার নৈতিক অধিকারই বা আমাদের কোথায়?

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ