গ্রন্থালোচনা : ‘ইউরোপের সাত দেশে বাইশ দিন’

গ্রন্থালোচনা : ‘ইউরোপের সাত দেশে বাইশ দিন’

ফায়যুর রাহমান : ঝড়ের বেগেই ঝটিকা সফর তাঁর। মাত্র বাইশ দিনে ইউরোপের সাত দেশ ভ্রমণ। শুরুটা ২০২২ সালের ৫ আগস্ট। আর সব শেষ করে ঘরে ফেরা ২৬ আগস্ট। এই মধ্যবর্তী সময়ই একজন ব্যাংকারের ইউরোপ ভ্রমণের গল্প। ‘ইউরোপের সাত দেশে বাইশ দিন’। বইটি একই সঙ্গে ভ্রমণকাহিনি এবং অটোবায়োগ্রাফি। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশেবিদেশে’ কিংবা মঈনুস সুলতানের ‘কাবুলের ক্যারাভান সরাই’ নয়, জাবেদ আহমদের ‘ইউরোপের সাত দেশে বাইশ দিন’ও আপনার ভ্রমণসাহিত্যপাঠের রসদ যোগাবে, সন্দেহ নাই। 

জাবেদ আহমদ পেশায় একজন ব্যাংকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক। ছিলেন সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন দৈনিক সিলেটের ডাকে। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে পরিচিতি তাঁর। ঘোরাঘুরির সখ সেই ছেলেবেলা থেকে। সংগঠক হিসেবে ঘোরাঘুরিতে দেশের সীমানা মাড়িয়েছেন কিশোরবেলায়। আর সেটা পূর্ণতা পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে। সম্প্রতি ঘুরে এলেন ইউরোপের সাত দেশ। ৫ আগস্ট (২০২২) শুক্রবার বেরিয়েছিলেন ঘর থেকে। 

গ্রিনলাইন বাসে সিলেট থেকে রওনা হন ঢাকার পথে। বাসযাত্রা দিয়েই শুরু হয় তাঁর তিন সপ্তাহের ইউরোপ ভ্রমণ। সিলেট থেকে ঢাকা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর। সেখান থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুল। ইস্তাম্বুল থেকে রোম। এভাবেই ইতালি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লন্ডন হয়ে এক ব্যাংকারের ইউরোপ দেখা।    

গত অক্টোবরে (২০২৩) প্রকাশ হয়েছে বইটি। বইটির ভূমিকায় গল্পকার সেলিম আউয়াল লিখেছেন ‘একজন জাবেদের পর্যটক হয়ে ওঠার’ গল্প। দুরন্ত কৈশোর থেকে খেলাধূলার সাথে সাংগঠনিক তৎপরতা কীভাবে জাবেদ আহমদকে পর্যটক বানিয়ে দেয়, সেই কাহিনি। কৈশোরে তিনি ও জাবেদ আহমদের পরিবার সিলেটের আম্বরখানা সরকারি কলোনীতে থাকা অবস্থায় কত সংগঠনে জড়ানো- মহামেডান ফ্যান ক্লাব, আমরা মহামেডান, বাংলাদেশ ল স্টুডেন্ট ফেডারেশন, ভয়েস অব আমেরিকা ফ্যান ক্লাব, আরও কত কী! এভাবে কিশোর সংগঠক থেকে বেড়ানোর শুরু। সিলেট থেকে ঢাকা। ঢাকা থেকে কলকাতা। এভাবেই দেশের সীমানা পেরোনো। মাকে নিয়ে হজের সফরে সৌদি আরব, এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে শ্রীলংকা ভ্রমণ। সেখান থেকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারত। 

সেলিম আউয়াল লিখেছেন, ‘জাবেদের সর্বশেষ ভ্রমণ ২০২২ সালে। ঝড়ের বেগকেও যেন হার মানালো তার ভ্রমণ। মাত্র বাইশ দিনে ইউরোপের সাতটি দেশ ভ্রমণ। এইসব দেশের দর্শনীয় স্থানকে দেখার সাথে সাথে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে সাক্ষাতের কাজটিও সারেন দ্রুততার সাথে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিনের ভ্রমণকাহিনিটিও বর্ণনা করেন ফেসবুকে। সেইসব কাহিনির সংকলন ‘ইউরোপের সাত দেশে বাইশ দিন’। জাবেদের ভ্রমণের একটি প্রধান বৈশিষ্ট হলো সময়ের সদ্ব্যবহার এবং কম খরচে বেশি মজার কৌশল। যা একজন ভ্রমণকারীর জন্যে অপরিহার্য।’ 

বইটির বিশেষত্ব হলো এতে লেখকের বর্ণনার পাশাপশি তাঁর আরো দু’জন সফরসঙ্গীর দুটো লেখা সংযোজন করা হয়েছে। যা বাইটতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। এই দু’জন হলেন সাংবাদিক আহমেদ শামীম ও সাংবাদিক হাবিবুর রহমান। দু’জনেই দৈনিক সিলেটের ডাকে লেখকের সহকর্মী ছিলেন। বইটিতে বিভিন্ন সময়ে লেখকের সৌদি আরব, শ্রীলংকা, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া সফরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সংযুক্ত হয়েছে।

লেখকের সাবেক সহকর্মী হাবিবুর রহমান লিখেছেন, ‘ইউরোপে আছি অনেক দিন। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া নিখাঁদ ভ্রমণের জন্য কোথাও যাওয়া হয়নি। এজন্য মনে আক্ষেপ ছিলো। ভ্রমণপিপাসু মনের সেই অপূর্ণতা ঘুচলো আমার এককালের দৈনিক সিলেটের ডাকের সহকর্মী ও একনিষ্ঠ বন্ধু জাবেদ আহমদের কল্যাণে। ৬ আগস্টের পর আমি তিন সপ্তাহ ফ্রি আছি জানার পর জাবেদ জানালো, ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় সে ইতালির রোমে আসছে। সেই সমন্বিত পরিকল্পনার প্রথম ধাপ ছিলো প্যারিস থেকে রোমযাত্রা, আমার জীবনের দীর্ঘতম বাস-ভ্রমণ। ইউরোপ ভ্রমণের প্রথম যাত্রায় জাবেদ ৬ আগস্ট তুরস্কের ইস্তাম্বুলে পৌছে। সেখানে বিরতিহীনভাবে একের পর এক দর্শনীয় স্থান দেখে ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছবি ও বিবরণী দিয়ে যাচ্ছে। আমি বাসে বসে তা দেখছি।

৭ আগস্ট ২০২২, ফ্রান্সের সময় সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় প্যারিস থেকে রোমের উদ্দেশ্যে আমাকে বহনকারী বাসটি যাত্রা শুরু করে। আসলে গ্রীষ্মকালে এ সময়কে বিকালই বলা ভালো। এখানে সূর্যাস্ত হয় নয়টা থেকে দশটার দিকে। ফ্রান্সের দীর্ঘতম দিন জুনের ২১ তারিখ স্থানভেদে দিবালোক থাকে প্রায় ১৭ ঘন্টার মতো। বিকেলের একপেশে রোদ খুবই তীক্ষè হয়। প্যারিসের সীন নদীর কূল ঘেঁষে ছুটে চলা বাস থেকে পর্যটকবাহী প্রমোদ তরীগুলোর আসাযাওয়া দেখা যাচ্ছে। আট-দশ মিনিট পর বাসটি বাঁক নিয়ে নদী পার হয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করলো। ঘন্টাখানেক চলার পর দেখা মিললো ফসলী মাঠ। কোথাও গম কাটা হয়ে গেছে। কোথাও পাঁকার অপেক্ষা। মাঝেমধ্যে ভুট্টা ও সূর্যমুখী ফুলের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের বুক চিরে সর্পিল মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস ছুটে চলছে। বাসের জানালা থেকে দেখা দৃশ্য ছেলেবেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে।’

‘দুবার বিরতি নিয়ে প্রায় ছয় ঘন্টা পর আমাকে বহনকারী বাসটি ইতালির সীমানায় প্রবেশ করে। রোম প্রবেশের দু’শো কিলোমিটার আগে থেকে প্রচন্ড যানজট থাকায় আমাদের গতি শ্লথ হয়ে যায়। সে কারণে নির্ধারিত সময়ের সাড়ে তিন ঘন্টা পর রোমে পৌছাই। .. জাবেদ ইতালি সময় বিকেল ৬টা ৪৩ মিনিটে রোম এসে পৌছার কথা। আমি বাস থেকে নামি মাত্র আধ ঘন্টা আগে। ততক্ষণে জাবেদকে বহনকারী বিমানটি রোম বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। চল্লিশ মিনিট পর বিমানবন্দরে পৌছে দেখি জাবেদ এক বাঙালি ভাইয়ের সহায়তায় বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল থেকে বের হয়ে ট্রেন প্লাটফর্মের লাউঞ্জে বসে আছে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর দেখা হওয়ার আনন্দে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরি। এ আনন্দ ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময়ের চেয়ে অনেক বেশি।’

ইতালির ফিউমিচিনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তারা ভ্যাটিকান সিটি, রোম নগরী, শিল্পনগরী মিলান ঘুরে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহর হয়ে প্যারিসের উদ্দ্যেশে রওনা হলেন। প্যারিসের রেক্সি ইন্টারন্যাশনাল বাস টার্মিনাল থেকে ফ্রান্স ভ্রমণ শুরু। ফরাসি রাজার রাজপ্রসাদ, আইফেল টাওয়ার, বিখ্যাত প্যারিস গেইট ইত্যাদি দেখে নতুন গন্তব্য হয় বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস। ব্রাসেলস থেকে প্যারিস হয়ে লন্ডনের পথে রওনা।

সাংবাদিক আহমেদ শামীম লিখেছেন, ‘বন্ধু জাবেদের সাথে দেখা হবে প্রায় ১৬ বছর পরে। বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম। ১৯৯৪ সাল থেকে একসাথে কাজ করার সুবাদে আমাদের বন্ধুত্বের যাত্রা। জাবেদ ইউরোপ সফর শেষে লন্ডনে আসে ১৬ আগস্ট ২০২২। ... প্যারিস থেকে ট্রেনযোগে লন্ডন পৌছে বার্মিংহামে তার সমন্ধির বাসায় যাওয়ার কথা। তাই আমরা সপরিবারে তাকে নিয়ে রাগবিতে কলিমের বাসায় যাওয়ার পরিকল্পনা করি। যেহেতু রাগবি থেকে বার্মিংহাম বেশি দূরে নয়, তাই কলিম বলছিলো জাবেদকে তার ওখানে নিয়ে যেতে। সেখান থেকে রাতে তাকে আমরা বার্মিংহাম পৌছে দেবো। রাত প্রায় নয়টায় আমরা রাগবি এবং ১টার দিকে বার্মিংহামে পৌছি। .. জাবেদ সাড়ে ৫টায় কিংক্রস স্টেশনে আসবে, তাই আমরা পরের স্টেশন অর্থাৎ ইউস্টনের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে জাবেদের একজন কলিগ, বর্তমানে ইংল্যান্ডের শেফিল্ড নিবাসী হযরত আলী আমাকে ফোন দিয়ে বললেন তিনি স্টেশনে জাবেদের সঙ্গে দেখা করবেন। তার ফোন পেয়ে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। তাকে বলি, আমার দেরি হলে তিনি যেন জাবেদকে রিসিভ করেন। আমি ইউস্টনে শেলি ও এলিজাকে নামিয়ে দিয়ে এসে দেখি জাবেদের ট্রেন এসে গেছে, তবে সে এখনো বেরোয় নি। ফুল ও গিফটসহ হযরত আলীকে সেখানে পেয়ে যাই। জাবেদ যখন বের হলো, দেখি ওর হাতে ৩ চাকা ভেঙে যাওয়া একটি লাগেজ। এটার দুর্দশা ঘটে নাকি ফ্রান্সে থাকতেই। পাঁজাকোলা করে ক’দিন থেকে নাকি লাগেজটি বহন করে চলেছে। এদিকে তার চাচাতো ভাই খালেদ ফোন দিচ্ছেন বারবার। তিনিও কিংক্রস এসেছেন। .. জাবেদ ইংল্যান্ডে সংক্ষিপ্ত সফরে এসে লন্ডনে আমার বাসায় নামমাত্র থেকেছে। বেশিভাগ সময় বাইরে ঘোরাঘুরি ও খাওয়াদাওয়া হয়েছে। দেখেছে দর্শনীয় বহু স্থান, সাক্ষাৎ হয়েছে আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, যাদের সাথে দেখা নেই যুগ যুগ ধরে। সেই সুযোগে আমারও অনেকের সাথে দেখা হয়ে গেলো। জাবেদের বদৌলতে এক অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটে লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা সংলাপ পত্রিকা অফিসে। সেখানে অন্যান্য শুভার্থীর সাথে সিলেটের ডাকের আমরা সাতজন সাবেক রিপোর্টার মিলিত হয়েছিলাম। তারা হলেন, জামাল আহমদ, মাহবুবুর রহমান, সালেহ আহমদ খান, মশাহিদ আলী, আবদুল মুকিত অপি, জাবেদ আহমদ ও আমি শামীম। ওই রাতে আরেক সাবেক সহকর্মী মোসলেহ উদ্দিনের ব্যবসায়িক কার্যালয়ে এবং পরের দিন রয়েল লন্ডন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিলেটের ডাকের সাবেক সাব এডিটর আশিক মোহাম্মদ এবং তাকে দেখতে যাওয়া সাবেক নির্বাহী সম্পাদক মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তারের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে। ডাক পরিবারের দশজন সাবেক কর্মী ছাড়াও আমাদের পরম শুভাকাঙ্খী সুফি সুহেল আহমদ, সাংবাদিক ডা. আনিস রহমান, শাহেদ রহমান ও আনসার মিয়াসহ অসংখ্য গুণী মানুষের সাথে দেখা হয় জাবেদকে কেন্দ্র করে। সংক্ষিপ্ত সফরে জাবেদ দেখলো, ঘুরলো, সান্নিধ্য পেলো প্রবাসী অনেক বন্ধু-স্বজনের।’

বইটি ফ্ল্যাপে দৈনিক সিলেটের ডাকের চিফ রিপোর্টার মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন, 'ভ্রমণপিপাসু জাবেদ আহমদ সময় পেলেই দেশের নানা প্রান্তে ছুটে চলেন। কখনো দল বেধে, কখনো একা। দেশের সবক’টি বিভাগে তিনি ভ্রমণ করেছেন। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে তিনি ইউরোপের সাতটি দেশ ভ্রমণ করেছেন, যার সবিস্তারে ছবিসহ বিবরণ ‘ইউরোপের সাত দেশে বাইশ দিন’ গ্রন্থে ফুটে উঠেছে।’

জাবেদ আহমদের ‘ইউরোপের সাত দেশে বাইশ দিন’ বইটি প্রকাশ করেছে কৈতর প্রকাশন। বোর্ডবাঁধাই ১৬০ পৃষ্ঠার ঝকঝকে ছাপা বইটির মূল্য রাখা হয়েছে তিনশো’ টাকা। পাওয়া যাবে কৈতর প্রকাশন ছাড়াও সিলেটের স্থানীয় লাইব্রেরিগুলোতে।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক