আগুন মৃত্যুর শেষ কোথায়

আগুন মৃত্যুর শেষ কোথায়

রয়েল ভিউ ডেস্ক:
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে প্রায়ই ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। বসতবাড়ি, কেমিক্যাল গুদাম, গার্মেন্ট কারখানায়, শপিং কমপ্লেক্স, সাধারণ মার্কেট, ফ্ল্যাট-বাড়ি এমনকি গরিবের একমাত্র আশ্রয়স্থল বস্তিতেও ঘটছে অগ্নিকাণ্ড। এসব অগ্নিকাণ্ডের লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়ে পঙ্গুত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে অনেকে, আর ঝড়ছে বহু তাজা প্রাণ। এভাবে অগ্নি দুর্ঘটনায় নির্মম মৃত্যুর শেষ কোথায় জিজ্ঞাসা সমাজ সচেতনদের।

আগুনের লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়ে শুধু একজন মানুষেরই মৃত্যু হয় না, তার সঙ্গে পরিবারগুলোও যেন হয়ে যায় নিঃস্ব। দুইবেলা ভাতের জন্য, পরিবারের ভরপোষণের জন্য মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী নিজের শ্রম বিক্রি করে আসছেন। শ্রমিকের রক্ত-ঘামে দিনে দিনে সভ্যতা গড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে শহর, নগর-বন্দর। তৈরি হয়েছে, হচ্ছে কলকারখানা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব কারখানায় নিশ্চিত করা হয় না শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি। ফলে ফি বছর নিয়মিত বিরতিতে চলে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল। নানা অব্যবস্থাপনায় ভরা কলকারখানাসহ বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিকদের এক প্রকার ‘হত্যা’ চলছে। কখনো আগুনে অঙ্গার হয়ে বা কখনো ভবন ধসে চাপা পড়ে চিড়েচ্যাপ্টা মৃত্যু যেন শ্রমিকদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু শ্রমিকই নয়, নানা অব্যবস্থাপনায় আগুন ও ভবন ধসে মারা যাচ্ছেন শতশত সাধারণ মানুষ ও আবাসিক বাসিন্ধারা। গত ৪ জুন শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির বিএম ডিপোতে এরকমই এক ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটল। আর ঝড়ে গেল ৫১টি তাজা প্রাণ।গত ৮ জুলাই রাতে ভয়াবহ আর একটি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায়। ফায়ার সার্ভিসের দীর্ঘ ২০ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও এরই মধ্যে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় ৫২ জন। কারখানা ভবনের শুধু চারতলা থেকেই ৪৯টি অগ্নিদগ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

নগর বিশ্লেষক ও স্থপতি ইকবাল হাবিব নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর দুইটি কমিটি ১৭টি সুপারিশ করেছিল। প্রতি বছর নিমতলী দিবসে আমরা দাবি তোলা সত্ত্বেও এবং বারবার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। যার কারণে একের পর এক অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। এভাবে অগ্নি দুর্ঘটনায় বেদনার্ত ও নির্মম মৃত্যু আর কত হবে।’ তিনি বলেন, ‘এখানে জনসচেতনতা খুব জরুরি।’ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশে তৈরি পোশাক খাতে বিভিন্ন সংস্কারের কারণে সেখানে অগ্নি দুর্ঘটনা কমে এলেও তার বাইরে বিভিন্ন খাতের কর্মক্ষেত্রে অগ্নি দুর্ঘটনা বাড়ছে।’

ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে সারাদেশে মোট ৫ হাজার ৩৭৬টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩ কোটি টাকা। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৯৭ সালে ৫ হাজার ৮০২টি, ১৯৯৮ সালে ৫ হাজার ৩টি, ১৯৯৯ সালে ৫ হাজার ২০৭টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। ২০০০ সালে ৫ হাজার ৩১৫টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ৯৭১টি, ২০০২ সালে ৫ হাজার ৪০৪টি, অপরদিকে ২০০৩ সালে তা বেড়ে গিয়ে ৬ হাজার ২৮৯টি, পরের বছর ২০০৪ সালে তা আরো বেড়ে গিয়ে ৭ হাজার ১৪০টিতে দাঁড়ায়। কিন্তু এর পরের বছর ২০০৫ সালে ৫ হাজার ৪৭৫টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এই ১০ বছরে অগ্নি দুর্ঘটনায় হতাহতের কোনো তথ্য দিতে পারেনি সংস্থাটি।

সংস্থাটির পরে দেয়া তথ্যে ২০০৬ সালে ৯ হাজার ৫৪২টি অগ্নিদুর্ঘটনায় আহত ৮৭৩ জন, নিহত ৯১ জন। একই বছর আহত হন ৪৮ জন ও আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারান একজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী।

২০০৭ সালে ৯ হাজার ১৯৬টি অগ্নিকাণ্ডে আহত হন ১ হাজার ৪৫৫ জন ও নিহত হন ১৬০ জন। ২০০৮ সালে ৯ হাজার ৩১০টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ২২৯ জন, আহত হন ১ হাজার ৩৫৬ জন। ২০০৯ সালে ১২ হাজার ১৮২টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১১৮ জন। ২০১০ সালে ১৪ হাজার ৬৮২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৬৩ জন।

২০১১ সালে ১৫ হাজার ৮১৫টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ৩৬৫ জন। ২০১২ সালে ১৭ হাজার ৫০৪টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২১০ জন। ২০১৩ সালে অগ্নি দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৯১২তে। নিহত হন ১৬১ জন। ২০১৪তে ১৭ হাজার ৮৩০টি অগ্নি দুর্ঘটনায় ৭০ জন প্রাণ হারান। ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৮৮টি অগ্নিদুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৬৮ জন। ২০১৬তে ১৬ হাজার ৮৫৮টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫২ জন। ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নি দুর্ঘটনায় মারা যান ৪৫ জন। ২০১৮তে ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৩০ জন। ২০১৯ সালে ১৮৫ জন নিহত ও ৫৭১ জন অগ্নি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। ২০২০ সালে অগ্নি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে ১৫৪ জন এবং আহত হয় ৩৮৬ জন। ২০২১ সালে অগ্নি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে ২১৯ জন এবং আহত হয় ৫৭৬ জন।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুসারে বর্তমানে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ১ হাজার ১৮৭টি, ঝুঁকিপূর্ণ ৩ হাজার ৫১৮টি স্থাপনা রয়েছে। এরমধ্যে শুধু রাজধানীতে রয়েছে ১ হাজার ৬৯টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৮৩টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা। ঢাকায় এসব বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় গড়ে উঠেছে অফিস, গার্মেন্টস, শিল্পকারখানা, মার্কেট ও শপিং মল। এর অনেকেরই সংশ্লিষ্ট সংস্থার বৈধ অনুমোদন নেই। মানা হয় নাই বিল্ডিং কোড। কারখানায় ছোট ছোট কক্ষে বসানো হয় ভারী ভারী যন্ত্রপাতি। অনেক অফিস ও কারখানায় আলাদা গুদাম না থাকায় ভবনের মধ্যেই বিভিন্ন তলায় মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়। কখনো সেখানে থাকে না ওঠানামার জন্য প্রশস্ত সিঁড়ি ও জরুরি বহির্গমনের আলাদা কোনো পথ।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে জানা গেছে, নিয়ম না মেনে ভবন বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা, কোনো স্থাপনা নির্মাণ করার পর অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যেসব কারণে তার কোনো ধরনের পরিকল্পনা না থাকা। এমনকি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শুরুর পর থেকে কর্মরতদের কখনো আগুন লাগলে কীভাবে তা প্রতিরোধ করতে হবে বা কোন কোন পদ্ধতিতে সহজেই অগ্নি দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব তার সামান্যটুকু প্রশিক্ষণ পর্যন্ত প্রদান করেনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীগণ নিয়মিত বিভিন্ন ভবনে অগ্নি মহড়া প্রদান করলেও এসব প্রতিষ্ঠান মালিকগণ তেমন একটা গুরুত্বও পর্যন্ত দেন না। ফলে আগুন লাগলেই এসব বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে ঘটে মহাবিপত্তি। ফলে আগুনে পুড়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয় ও বেঘোরে হারায় কত তরতাজা প্রাণ।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানা যায়, অগ্নি আইন না মানার কারণে এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা জরিমানা আদায় করতে দেখা যায়নি। ফলে ভবন মালিকরা সহজে অগ্নি আইন মানতে আগ্রহ দেখান না। যার পরিণাম জীবন দিয়ে ভোগ করতে হয় সাধারণ নাগরিকদের।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নয়া শতাব্দীকে জানান, মোট কর্মক্ষেত্রের সবচেয়ে বেশি অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে শপিং মল যা ৪২ শতাংশ। এরপরের তালিকায় রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা ২২ শতাংশ। স্বাস্থ্যসেবা খাত ১৯ দশমিক ২ শতাংশ ঝুঁকিতে আছে। ফায়ার সার্ভিসের কাজে অনেক আধুনিকায়ন হলেও অগ্নি দুর্ঘটনার ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারছে না।

ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় বছরে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৭৯৫ শ্রমিক। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ২১৩ জন।

সংস্থাটি জানায়, এসব দুর্ঘটনায় মারা যাওয়াদের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। বিলসের দেয়া অন্য একটি তথ্যানুযায়ী, ২০০৬ সালে আরেকটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইল কারখানায়। আগুনে প্রাণ যায় ৬৫ জন শ্রমিকের। এর মধ্যে ৫২ জন পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে শান নিটিংয়ে আগুনে নিহত হয় ২২ জন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের আলোচিত রানাপ্লাজা ধসের ঘটনায় এক হাজার ১২৯ শ্রমিকের মৃত্যু এবং ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল রাতে আশুলিয়ার পলাশবাড়ী এলাকায় স্পেকট্রাম কারখানার সাততলা ভবন ধসে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান ৬৩ শ্রমিক। আহত হন আরো ৮৪ জন। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুই শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ শ্রমিক দগ্ধ হয়ে এবং ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন।