দেশব্যাপী অবৈধ ক্লিনিক বন্ধে অভিযানে চিকিৎসকদের পকেটে টান!

দেশব্যাপী অবৈধ ক্লিনিক বন্ধে অভিযানে চিকিৎসকদের পকেটে টান!

রয়েল ভিউ ডেস্ক:
অনিবন্ধিত, অবৈধ, অনুমোদনের জন্য আবেদনই করেনি এমন ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়ায় সরকারি ঘোষণা এবং অব্যবহিত পরেই দেশব্যাপী স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং ভোক্তা অধিকারের অভিযানে চিকিৎসক মহলে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কারণ এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের আয়ের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নিবন্ধিত চিকিৎসকদের পকেটেই যেত। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। গত ১০ বছরে এই অবৈধ লেনদেনের চর্চা বহুগুণে বেড়েছে।

রাজধানী ঢাকার খিলক্ষেতে একটি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার এই সেন্টারে রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যত টাকা উপার্জিত হয় সেটির শতকরা ৪০ ভাগ চিকিৎসকদের দিয়ে দিতে হয়। যিনি বা যারা রোগী ‘রেফার’ করেন তারা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই এই অর্থের ভাগিদার হয়ে যান। সঙ্গত কারণেই এই পরিচালক নিজের বা চুক্তিবদ্ধ চিকিৎসকদের নাম জানাননি।

ঢাকারই কিছু সরকারি হাসপাতাল, যেমন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, বিএসএমএমইউ, হূদরোগ হাসপাতাল, আজিমপুর ম্যাটারনিটি হাসপাতাল, পুরোনো ঢাকার কোর্ট কাচারি এলাকায় অবস্থিত ন্যাশনাল হাসপাতাল, সরকারি শিশু হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালে ঘুরে দেখা যায়, সকাল হতে না হতেই অসংখ্য মোটরসাইকেলে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভরা ভিড় জমান হাসপাতাল প্রাঙ্গণগুলোতে। এদের সঙ্গে মিশে থাকে দালাল শ্রেণির কিছু লোক।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের আউটডোরের বাইরের প্যাসেজে উৎসুকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মোশাররফ নামের এক দালাল নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমরা রোগীদের বিভিন্ন টেস্ট করাতে সাহায্য করি। গ্রাম থেকে অনেকেই আসেন। তারা তো রাস্তাঘাট চেনেন না। আমরা ওদের হেল্প করি।

টেস্ট তো হাসপাতালেই হয়। তাহলে রোগীদের বাইরে নিয়ে যেতে হয় কেনো? এমন প্রশ্নের উত্তরে মোশাররফ এক গাল হেসে বলেন, হাসপাতালে টেস্ট করাতে গেলে অনেক ঝামেলা, সময়ও লাগে অনেক। এদিকে, ডাক্তার স্যাররা রোগীদের বলে দেন তাড়াতাড়ি রিপোর্ট নিয়ে যেতে। আর বুঝেনই তো। আমরা সারাদিন এখানেই থাকি। কিছু টাকা ইনকাম না করলে কিভাবে চলবো? ডাক্তার স্যাররাও কমিশন পান। সবাই মিলে মিশে ভালো থাকি। রোগীদেরও উপকার হয়।

একই চিত্র অন্যান্য হাসপাতালেও। ন্যাশনাল হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেন, এদের আইন করে, নিয়ম করে বাদ দেয়া যাবে না। এরা জোঁকের মতো। মানুষও এদের ওপরই নির্ভরশীল।

গাজীপুরের রেডিয়াম হাসপাতালের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা গাজীপুরে সুনামের সঙ্গে ২০ বছরের ওপরে সেবা দিয়ে আসছি। যেসব অসঙ্গতির কথা বললেন সেগুলো আমাদের এখানে হয় না। আমাদের এখানে টেস্টের ওপর কোনো কমিশন নেই। তবে, যেসব ডাক্তারের চেম্বারে টেস্ট করার সুযোগ থাকে না তারা রোগী ‘রেফার’ করার বিপরীতে টাকা নিয়ে থাকেন। এটা সবারই জানা। আমরা অবশ্য ডাক্তারদের কমিশন দেই। ইদানিং অনেক নিবন্ধনহীন ক্লিনিক এবং সেন্টার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ওইসব ডাক্তারদের আয় কমে গেছে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে।

রাজধানীর শ্যামলী, আদাবর, কলেজগেট এবং আগারগাঁওয়ের বেশ কিছু ক্লিনিক গত দুই সপ্তাহের অভিযানে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে, এই বন্ধকরণের প্রক্রিয়ার মধ্যেও কিছু অসাধুতা ঢুকে পড়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে অবৈধ এবং অনুমোদিত ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে; কিন্তু যারা অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে তাদেরকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। কিন্তু আবেদনের সময়কাল এই বিবেচনায় আসেনি। এর ফাঁক গলে কিছু ক্লিনিক বন্ধের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার ফুরসত খুঁজছে। সরকারি নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে তারা আবেদন করার চেষ্টা চালিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটানোর বিষয়টি তো আছেই।

শ্যামলীর একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্লিনিকের মালিক জানালেন, তিনি সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শিগগিরই ক্লিনিকটি খুলতে সমর্থ হবেন। যোগাযোগ চলছে। নয়া শতাব্দীকে তিনি আরো বলেন, সরকার আন্তরিকভাবেই স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে চাইছে; কিন্তু চিকিৎসা সেবার সঙ্গে জড়িতরা না চাইলে কাজটি কঠিন। শুধু আইন করে শৃঙ্খলা ফেরানো যায় না। চিকিৎসক, ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ, ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের মালিকেরা এই খাতকে পুরোপুরি ব্যবসা মনে না করে সেবা হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতায় পৌঁছলেই কেবল সার্বিক শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে।

জানা যায়, গত ২৮ মে থেকে চলা অভিযানে বন্ধ হয়েছে ১ হাজার ৩৩৪টি প্রতিষ্ঠান। ৩১ মে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়ে আরো বলা হয়, ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে উক্ত তারিখে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়নি। তবে চট্টগ্রামে ২২টি, রাজশাহীতে ৫৮টি, রংপুরে ৪৯টি, ময়মনসিংহে ২৬ টি, সিলেটে ৩৫ টি ও খুলনায় ৮টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সারাদেশে এক হাজার ৩৩৪টি অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক বন্ধ করা হয়েছে। অভিযানে ঢাকা বিভাগে ২৮৬ টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৩ টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে বন্ধ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৮টি হাসপাতাল, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ২১২টি, রাজশাহী ১৯৩টি, রংপুরে ৭৩টি, ময়মনসিংহ ১৪৭টি, বরিশাল ৬৫টি, সিলেটে ৪৭টি ও খুলনায় ৩১১ টি প্রতিষ্ঠান।

রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানোর সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ জরিমানাও করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জরিমানা করতে পারেননি। কারণ জরিমানা করার ক্ষমতা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নেই বলে তারা শুধু অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারছেন। ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের সাথে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ ব্যাপারে কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে একই অপরাধে স্বাস্থ্য অধিদফতর কেবল অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারছে কিন্তু ভোক্তা অধিকার জরিমানা করছে।

এ দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর সর্বশেষ তথ্যে জানিয়েছে, তারা ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১২টিসহ ঢাকা বিভাগে ১৬৭টি প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম বিভাগে ২২৯টি, রাজশাহী বিভাগে ৭৮টি, রংপুর বিভাগে ১৪টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৯৬টি, বরিশাল বিভাগে ৫৯টি, সিলেট বিভাগে ৩৫টি এবং খুলনা বিভাগে ২০৪টিসহ মোট ৮৮২টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করেছে।

অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, তালিকা ধরে অবৈধদের বন্ধ করে দেয়ার অভিযান চলমান থাকবে। ইতোমধ্যে যারা লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে তাদের দ্রুত লাইসেন্স দেয়া হবে। অবৈধ হাসপাতালের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে এবং ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

সারা দেশে কয়টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার রয়েছে এর সুনির্দিষ্ট তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে, সারা দেশে প্রায় ২০ হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১১ হাজার প্রতিষ্ঠানের সরকারি লাইসেন্স রয়েছে। এর বাইরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পর্যবেক্ষণাধীন রয়েছে প্রায় ছয় হাজার প্রতিষ্ঠান। অন্য দিকে লাইসেন্স পাওয়ার আবেদন না করেই তিন হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানো হচ্ছে।

সারা দেশে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্ভিস অফিস, উপজেলা প্রশাসন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তারা তাদের এলাকার বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে তাদের বৈধ কাগজপত্র চাচ্ছেন। দেখাতে না পারলে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই বলে একযোগে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। একযোগে সব অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে শেষ পর্যন্ত এতে ফাঁক-ফোকর থেকেই যেতে পারে।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে অনলাইন পদ্ধতিতে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হয়। চার বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত এর আওতায় আসেনি সব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার। এর আগে ২০২০ সালের ২৩ আগস্টের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন না করলে হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সে সময় করোনা মহামারী শুরু হলে জোরালোভাবে অভিযান চালানোর মাঝখানেই তা থেমে যায়। দেশের বাইরে সিভিল সার্জন অফিস, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তারা ছাড়াও জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। গত ২৬ মে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তিন দিনের মধ্যে অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশনা জারির পর গত ২৮ মে থেকে অভিযান শুরু হয়।