আব্দুস সামাদ আজাদ’র ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

আব্দুস সামাদ আজাদ’র ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

রয়েল ভিউ ডেস্ক :
ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক মন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, প্রয়াত জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ’র ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এ উপলক্ষে তাঁর জন্মস্থানে জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও আব্দুস সামাদ আজাদ স্মৃতি সংসদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা সভা ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম জানান, উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আব্দুস সামাদ আজাদের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, বেলা ১১টায় আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠিত হবে।

আব্দুস সামাদ আজাদ স্মৃতি সংসদের সদস্য জয়দ্বীপ সূত্রধর বীরেন্দ্র জানান, স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে শ্রদ্ধা নিবেদন, আব্দুস সামাদ আজাদ মিলনায়তনে আলোচনা সভা, ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও তাঁর জন্মভিটা গ্রামের বাড়ি ভূরাখালিতে দোয়া মাহফিল ও শিরনি বিতরণ করা হবে।
সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায়ই ২০০৫ সালের ২৭ শে এপ্রিল ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আব্দুস সামাদ আজাদ। দীর্ঘদুর্ভোগ, জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতনের হুলিয়া মাথায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অসাম্প্রদায়িক চেতনার সূর্যসন্তান হিসেবে দীর্ঘকাল রাজনীতি করে গেছেন তিনি।

আব্দুস সামাদ আজাদ সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার ভূরাখালি গ্রামে ১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম শরীয়ত উল্লা। সামাদ আজাদ শরিয়ত উল্লাহর দ্বিতীয় পুত্র। সামাদ আজাদ প্রথমে গ্রামের স্কুলে ও পরে দিরাই উপজেলার জগদল ভাটিরগাঁও স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষের পর ১৯৪৩ সনে তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক এবং ১৯৪৮ সনে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ইতিহাস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ইতিহাস বিষয়ে তিনি এম এ পাশ করেন। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে সরকার তার এম এ ডিগ্রি কেড়ে নেয়।

পুরো ভারতবর্ষ যখন এক দেশ তখনই রাজনীতিতে অভিষেক ঘটেছিলো আবদুস সামাদ আজাদের। ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হন তিনি। পরে অবিভক্ত আসামের সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৪৯—৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করায় বিপাকে পড়েন ছাত্রনেতা আবদুস সামাদ আজাদ। এমনকি এ ‘অপরাধে’ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে কিছুদিন অন্য দুটো পরিচয় নিজের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। তার ‘মাস্টার সাব’ পরিচয়টি অনেকেরই অজানা। অজানা রয়েছে তার বীমা নির্বাহী পরিচয়টিও। অজানা থাকারই কথা, রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে যে পরিচয় তিনি অর্জন করেছেন তার সামনে আর কোনো পরিচয় টিকে থাকতে পারেনি।

১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দেন আবদুস সামাদ আজাদ। তখন চলছে ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে আবদুস সামাদ আজাদকে কারাবরণও করতে হয়। রাজনৈতিক দক্ষতার কারণে ১৯৫৩ সালে যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান আবদুস সামাদ আজাদ। পরের বছর যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগ—যুবলীগ অধ্যায়ের ইতি ঘটিয়ে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন আবদুস সামাদ আজাদ। আদর্শগত কারণে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরলে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আবদুস সামাদ আজাদ কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে আটক হন তিনি। মুক্তি পান চার বছর জেল খাটার পর। ১৯৬৪ সালে আবারো গ্রেপ্তার হন তিনি।

স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তুঙ্গ সময়ে ১৯৬৯ সালে আবদুস সামাদ আজাদ ফিরে আসেন নিজের ঘর আওয়ামী লীগে। নির্বাচিত হন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তিনি সিলেট থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন।
আন্দোলনের পথ বেয়ে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দেন আবদুস সামাদ আজাদ। প্রথমে তিনি মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত। দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে আবদুস সামাদ আজাদ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে দুটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে পটপরিবর্তন হলে ষড়যন্ত্রীদের হাতে গ্রেপ্তার হন আবদুস সামাদ আজাদ। ভাগ্য ভালো থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন নইলে ৩রা নভেম্বর জেল হত্যা দিবসে ৪ জনকে নয় স্মরণ করতে হতো জাতীয় ৫ নেতাকে। প্রাণে বেঁচে গেলেও ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কারার অন্ধকারেই থাকতে হয় আবদুস সামাদ আজাদকে।

নিপীড়ন—নির্যাতনেও রাজনীতির মাঠ কখনোই ছেড়ে যাননি আবদুস সামাদ আজাদ। ভাষা আন্দোলন—মুক্তিযুদ্ধের পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও মাঠে ছিলেন শুরু থেকেই। এরশাদ সরকারের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে গণতন্ত্রের মুক্তিতে অসামান্য অবদান রাখেন তিনি। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সুনামগঞ্জ—৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ওই সময় আবার তিনি পান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব। সাফল্যের সঙ্গে তিনি তার সে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের পরবর্তী নির্বাচনেও তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায়ই ২০০৫ সালের ২৭শে এপ্রিল ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবদুস সামাদ আজাদ।