এবার নদী ও হাওরের মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি

এবার নদী ও হাওরের মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি

কাউসার চৌধুরী : নদী ও হাওরের মাছে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মাত্রাতিরিক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি মিলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিষিদ্ধ পলিথিন পরিণত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকে। আর নদী বা হাওরের মাছ সেই মাইক্রোপ্লাস্টিক খায়। পুষ্টিকর মাছ যেখানে মানবদেহের জন্য উপকারী; সেই মাছ এখন শুধুমাত্র পলিথিনের কারণে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশকর্মীরা জানান, সিলেটে নিষিদ্ধ এই পলিথিনের অবাধ বিপণন ও ব্যবহার চললেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনেই নগরের হাটবাজারসহ সর্বত্র এই নিষিদ্ধ পলিথিনের অবাধ ব্যবহার চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ কারোরই পলিথিন বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। এক সময় সিলেটে পলিথিনের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান পরিচালনা করা হলেও বর্তমানে তা অনেকটাই বন্ধ। 
মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ। যে সকল প্লাস্টিকের আকার ২ মাইক্রোমিটার  থেকে ৫ মিলিমিটারের মধ্যে, সে সকল প্লাস্টিককে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিক সাধারণত নারডল নামে পরিচিত। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও ওজোন হ্রাসের পাশাপাশি মাইক্রোপ্লাস্টিক একটি বড়ো বৈশ্বিক পরিবেশগত সমস্যা হয়ে ওঠে। আকারে ক্ষুদ্র হওয়ায় এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানে যেমন মাটি, পানি, বাতাসের সঙ্গে সহজেই মিশে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান। নদীর স্রোত, বৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক পুকুর, নদী এবং সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। সামুদ্রিক মাছসহ স্বাদুপানির মাছ এদের খাবার হিসেবে গ্রহণ করছে। ফলে এরা সহজেই প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করছে। খাদ্যশৃঙ্খলের প্রথম স্তরের খাদককে দ্বিতীয় স্তরের খাদক ভক্ষণ করে, দ্বিতীয় স্তরের খাদককে তৃতীয় স্তরের খাদক ভক্ষণ করে, তৃতীয় স্তরের খাদককে সর্বোচ্চ স্তরের খাদক ভক্ষণ করে। এভাবে খাদ্যশৃঙ্খলের পর্যায়ক্রমিক পরিক্রমায় মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করছে-যা শুধু মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারকই নয় বরং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে এক বিরাট হুমকিস্বরূপ বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।  
প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এ বিষয়ে সিলেটের ডাককে বলেন, পলিথিন নদী, হাওর, ডোবাসহ পানিতে অবাধে যাচ্ছে। নদী বা হাওরের মাছ মাইক্রোপ্লাস্টিক খায়। আবার মানুষজন এই মাছ খেয়ে থাকেন। আমার-আপনার পেটের ভেতরেও প্লাস্টিক প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এই মাছও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাছের ভেতরে মাত্রাতিরিক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকায় এই মাছ শিশুদের জন্যে মারাত্মকভাবে ঝূঁকিপূর্ণ। এছাড়াও পলিথিন ব্যাগে রাখা খাবার নিয়মিত খেলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনকি লিভার ও কিডনির বিভিন্ন জটিল রোগও হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক এডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, পলিথিন একটি বিপজ্জনক বস্তু। এটি সাড়ে চার’শ বছরেও মাটির সাথে মিশে না। পলিথিন মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। এর উৎপাদন বন্ধে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশে পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। শুধুমাত্র পলিথিনের কারণে মানবস্বাস্থ্য আজ বিপজ্জনক পর্যায়ে এসেছে। তাই মানবস্বাস্থ্য রক্ষায় পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক (উপসচিব) মোহাম্মদ এমরান হোসেন গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সিলেটের ডাককে বলেন, পলিথিন এক ধরনের প্লাস্টিক। এটা পচনশীল নয়। এজন্য সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। পলিথিনের অবাধ ব্যবহার বন্ধ করতে পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করছে। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে আমরা নিয়মিত অভিযানও পরিচালনা করছি। পলিথিনের অবাধ ব্যবহার বন্ধে জনসাধারণকেও এগিয়ে আসতে হবে।
জানা গেছে, পলিথিন রাসায়নিক তন্তুজাতীয় দ্রব্য। বিষাক্ত ও ক্ষতিকর প্রোপাইলিনের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বনের চারটি মলিকুলের সংমিশ্রণে তৈরি হয় পলিথিন। এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটা নানাভাবে মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে।
পলিথিনের এমন ভয়াবহতার কারণে ২০০২ সালের পহেলা মার্চ দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও এর উৎপাদন থেমে নেই। সিলেট বিভাগের পাইকারি হাট কালিঘাটে প্রতিদিন নিষিদ্ধ পলিথিন আসছে। একইভাবে লালদিঘিরপাড়, হকার মার্কেটে প্রতিদিন পলিথিনের বিশাল চালান আসছে। বন্দরবাজারের বিভিন্ন পাইকারি দোকানেও নিয়মিত আসছে এই নিষিদ্ধ পলিথিন। এ সকল এলাকার পাইকারি দোকান থেকে নিষিদ্ধ এই দ্রব্য নগরের সকল দোকানে চলে যাচ্ছে। কেবল সিলেট নগরী নয়; সিলেট বিভাগের প্রায় সকল হাটবাজারে কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি ছাড়াই অবাধে পৌঁছে দেয়া হয় পলিথিন।
সরেজমিন দেখা যায়, সিলেট নগরের প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজারে একজন ক্রেতা এক কেজি কমলা কিনলে তা পলিথিনের ব্যাগে ভরে দেন। ক্রেতা মামুনুর রহমান দোকানীকে পলিথিনের বদলে অন্য কোনো ব্যাগে দিতে বললেও দোকানী রমজান মিয়ার সাফ জবাব, পলিথিন ছাড়া অন্য কোনো কিছু নেই। পলিথিন ব্যাগের বিকল্পও কিছু নেই। তাই, পলিথিনের ব্যাগে করেই নিতে হবে। এমনকি দশ টাকার কাঁচা মরিচ কিনলেও এই পলিথিনের ব্যাগেই কাঁচা মরিচ দেয়া হচ্ছে। কেবল বন্দরবাজার নয় জিন্দবাজার, আম্বরখানা, মদীনা মার্কেট, রিকাবীবাজার, কাজিরবাজারসহ নগরের সর্বত্র পলিথিনের ব্যবহার চলছে। এক সময় ব্যবসায়ীদের মাঝে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে আতঙ্ক থাকলেও এখন তাদের মধ্যেও সেই ভয় আর নেই।