কাজ শেষ জুনে, উদ্বোধন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে

কাজ শেষ জুনে, উদ্বোধন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে

রয়েল ভিউ ডেস্ক:
পদ্মা মূল সেতুর কাজ বাকি মাত্র ৩ শতাংশ। দৃশ্যমান কাজের মধ্যে বাকি আছে সেতুর রেলিং লাগানো। চলছে সেতুর ওপর সড়কের কার্পেটিং, ভায়াডাক্ট কার্পেটিং, সেতুর কার্পেটিংকে পানিনিরোধী (ওয়াটারপ্রুফ) করা, ল্যাম্পপোস্ট ও গ্যাসের পাইপলাইন স্থাপন এবং বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ। সব মিলিয়ে মূল সেতুসহ সড়ক প্রকল্পের সার্বিক কাজের মাত্র ৮ শতাংশ বাকি।

এসব কাজ শেষ করে চলতি বছরের জুনে পদ্মা সেতু চালু করার কথা ছিল। তবে গত বুধবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ বছরের শেষ নাগাদ পদ্মা সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ দ্রুতগতিতে চলছে।  

এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী জুনে পদ্মা সেতু চালুর ইঙ্গিত দিয়েছেন। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এ বছরের শেষের দিকে পদ্মা সেতু চালু হবে। আমরা প্রত্যাশা করে আছি, আমাদের ফিন্যানশিয়াল বছর (অর্থবছর) যেটি জুনে শেষ হয়, এর মধ্যে সেতু চালু করতে পারব। 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্বোধন নিয়ে তাড়াহুড়ার সুযোগ নেই। হাতে সময় নিয়েই এমন বড় প্রকল্প উদ্বোধন করা উচিত। আর এর সঙ্গে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ও আছে।

কাজের বর্তমান অবস্থা
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে যে রেলিংগুলো বসানো হবে সেগুলো গত ১৭ মার্চ যুক্তরাজ্য থেকে সমুদ্রপথে রওনা হয়েছে। আগামী ১৫ মে সেগুলো দেশে পৌঁছানোর কথা। সেতু এলাকায় এসে পৌঁছানোর পর রেলিংগুলো বসাতে সময় লাগবে ১৫ দিনের মতো।

আর সেতুর সড়কে কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হলে রোড সাইনের কাজ বাকি থাকবে। এরপর করা হবে প্রাতিষ্ঠানিক জরিপ। জরিপে সেতুর সব সূচকের ফল ইতিবাচক হলে তা যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত বলে ঘোষণা করা হবে।

সব শেষ গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৭ শতাংশ। নদীশাসন কাজের অগ্রগতি ৯০.৫০ শতাংশ। সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ শেষ হয়ে গেছে। সেতুর অবশিষ্ট ওয়াটার প্রুফিং কাজের অগ্রগতি ৮৮.৬৭ শতাংশ, মূল সেতুর কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে ৬৫.৬৮ শতাংশ। মূল সেতুর ল্যাম্পপোস্ট কাজ ৭৬.৫২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। গ্যাস পাইপলাইন ৯৯ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ লাইনের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৯ শতাংশ।
 
সেতু চালু হওয়া নিয়ে যত কথা
গত ৩ মার্চ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হবে। ’ এর আগে মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামও বলেছিলেন, এ বছরের ৩০ জুন পদ্মা সেতু চালু হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সবাই নড়েচড়ে বসেছেন।

মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে গত বুধবার মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ থেকে কিছু মালামাল আসতে দেরি হওয়ায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে দেরি হচ্ছে। মার্চের মধ্যে যেসব মালামাল আসার কথা ছিল, সেগুলো আসতে পারেনি।

কী ঘটেছে
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেতুর রেলিংয়ের মালামালগুলো ইংল্যান্ড থেকে রওনা হতে দেরি হয়েছে। এগুলো মার্চে আসার কথা ছিল। এখন আসছে মে মাসে।

পদ্মা সেতুর সাইট অফিসের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী (সেতু) দেওয়ান আব্দুল কাদের বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় আমরা জুনের মধ্যেই সেতু প্রস্তুত করতে পারব। তবে রেলিং আসতে দেরি হচ্ছে সে কথা আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। হয়তো এ জন্যই কিছুটা সময় হাতে রেখে সেতুর উদ্বোধন পেছানো হচ্ছে। ’

জানতে চাইলে সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলামও বললেন, ‘জুনের মধ্যে সেতু প্রস্তুত হয়ে যাবে। বিস্তারিত বেশি কিছু বলা সম্ভব না। ’

সেতুর উদ্বোধন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়
সেতুসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পদ্মা সেতু অন্য আর দশটি প্রকল্পের মতো নয়। এর সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি যুক্ত। এই সেতু নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক পানি ঘোলা হয়েছে। তাই সেতু প্রস্তুত হলেও উদ্বোধন কবে হবে তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক বললেন, ‘পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই সরকার উদ্বোধন করবে। এর জন্য নির্বাচনসহ সমসাময়িক অনেক কিছুই সরকারের বিবেচনায় থাকবে। তবে এটাও ঠিক, সেতু প্রস্তুত হয়ে গেলে সাধারণ মানুষকে এর সুফল থেকে বেশি সময় বঞ্চিত রাখা উচিত হবে না। ’

শামছুল হক বলেন, ‘এমনিতেই সেতুর কাজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। ২০১৮ সালে নির্বাচন সামনে রেখে সেতু চালুর অনেক তোড়জোড় করা হয়েছিল। এখন সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে দ্রুত চালু করাই ভালো। কারণ এই সেতুকে কেন্দ্র করে আমরা যে অর্থনৈতিক লাভের আশা করেছিলাম তা যেন বেশি পিছিয়ে না যায়। ’

পদ্মা রেল সেতু
পদ্মা সড়ক সেতুর নিচেই রেল সেতু। সেখানে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু করা যায়নি। সেতুর এই অংশে স্থাপিত হবে গ্যাসের লাইন। সেই পাইপ এখন পানি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। গ্যাসলাইন বসানো শেষ হলে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে সেতুর রেললাইনের অংশটুকু বুঝিয়ে দেবে সেতু কর্তৃপক্ষ। এটা আগামী জুলাইয়ে হতে পারে।  

জানতে চাইলে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, জুলাইয়ের মধ্যে রেল সেতু বুঝে পেলে ডিসেম্বরের মধ্যে লাইন বসিয়ে সেতুর মাওয়া থেকে ভাঙা অংশে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ‘তবে রেলের জন্য সড়ক সেতুর উদ্বোধন আটকে থাকার কথা নয়। আমরাও চাই না আমাদের জন্য দেরিতে সেতু উদ্বোধন হোক। ’ 

তাড়াহুড়ার সুযোগ নেই
সেতু উদ্বোধনের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করার পরামর্শ দিচ্ছেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান এম শামীম জেড বসুনিয়া। তিনি বলেন, ‘সেতুর কার্পেটিং শেষে রোড মার্কিংয়ের কাজ থাকে। এটা সময়সাপেক্ষ। পুরো সেতু প্রস্তুত হওয়ার পর একটি জরিপ করতে হবে, তাতেও কিছুটা সময় লাগবে। 

শামীম জেড আরো বলেন, ‘তাড়াহুড়া করার কিছু নেই। আমরা এত দিন অপেক্ষা করতে পেরেছি, আরো কিছুটা অপেক্ষা করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। উদ্বোধনের জন্য কিছুটা সময় লাগবে। হাতে সময় নিয়েই উদ্বোধন করা উচিত। ’