গ্যাসের সর্বোচ্চ সরবরাহেও সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্র

গ্যাসের সর্বোচ্চ সরবরাহেও সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্র

রয়েল ভিউ ডেস্ক:
স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন ও আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ। বিশেষত জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সর্বোচ্চ সক্ষমতায় এখন এলএনজি দেয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। বিশেষ করে রমজান, গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরো সংকটপূর্ণ হয়ে উঠছে।

বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে গ্যাস সরবরাহে রেশনিং চালু করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সিএনজি ফিলিং স্টেশনে ৬ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার পাশাপাশি এখন শিল্প খাতেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। শিল্প-কারখানায় আগামী ১৫ দিন ৪ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে গতকাল বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। এর কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গ্রীষ্ম ও সেচের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তা বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। এজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন নির্বিঘ্ন করতে বেশকিছু খাতে গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ১১ হাজার ৪৫০ মেগাওয়াট। এ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হলে দৈনিক ১ হাজার ৪০০ এমএমসিএফ গ্যাস প্রয়োজন। অথচ বিপিডিবি পাচ্ছে এক হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ এমএমসিএফ গ্যাস। গ্যাসভিত্তিক যেসব কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না, সেগুলোর বিকল্প হিসেবে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে। রেশনিং করে চালাতে হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো।

দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় মূলত বৈশ্বিক জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ সংকট এবং আগে থেকে চলে আসা এলএনজি সরবরাহ সংকটের প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে এলএনজির অতি উচ্চমূল্য এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কোনোভাবেই বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমাতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ।

জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪৫০ কোটি ঘনফুট। অথচ বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে ৩১০ কোটি ঘনফুট। প্রতিদিন ঘাটতি থাকছে ১৪০ কোটি ঘনফুটের মতো। ঘাটতি গ্যাসের জন্য কখনো বিদ্যুৎকেন্দ্র, কখনো শিল্প-কারখানা আবার কখনো আবাসিক খাতে সরবরাহ কমিয়ে গ্যাস ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা হচ্ছে।

জ্বালানি বিভাগের ৯-১০ এপ্রিলের গ্যাস সরবরাহ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ দৈনিক ৩১০ কোটি ঘনফুটের বেশি। এর মধ্যে স্থানীয় গ্যাসের পরিমাণ ২২৪ কোটি এবং এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে ৮৬ কোটি ঘনফুট।

কভিডকালীন ও বৈশ্বিক জ্বালানির বিদ্যমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে বিকল থাকা টার্মিনাল পুনরায় উৎপাদনে এসেছে। ফলে বর্তমানে সরবরাহ সক্ষমতাও এখন সর্বোচ্চ। বর্তমানে দৈনিক ৮৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে এ দুটি টার্মিনাল দিয়ে।

এদিকে গ্যাস সরবরাহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলেও বিদ্যুৎ সরবরাহে উদ্বেগ তৈরি করছে। এরই মধ্যে সিএনজি খাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে গ্যাস বন্ধ থাকায় অসন্তোষ রয়েছে পরিবহন ও সিএনজি মালিকদের। অন্যদিকে শিল্প খাতে গ্যাস ব্যবহারে বিধিনিষেধ থাকায় উদ্বেগে পড়েছেন শিল্প মালিকরা। ঈদ সামনে রেখে গ্যাসের কারণে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে তা আর্থিকভাবে ক্ষতি করবে মালিকদের। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ সংকট তৈরি হওয়ায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রকট হচ্ছে ঢাকার বাইরে। বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দৈনিক ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।

বিদ্যুতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, আমাদের পরিকল্পনা হলো আসন্ন সেচ ও রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। যেসব জায়গায় কমিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা দরকার, সে প্রচেষ্টা আমাদের অব্যাহত রয়েছে। তবে যে সংকটটি হয়েছিল, সেটি মূলত বিবিয়ানা থেকে গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়ায়। এখন সেটি ঠিক হয়েছে।

প্রতি বছর দেশে গ্রীষ্ম, সেচ ও রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা অন্য সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়। এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা থাকে সাড়ে ১২-১৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন না হলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটও বেড়ে যায়।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এ অবস্থা তৈরি হওয়ার কারণ মূলত ভুল পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোনো। এ কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংকট তৈরি হয়েছে। এসব সংকট আগে থেকে সমাধান করার সুযোগ ছিল। তবে আমদানিনির্ভর জ্বালানিতে মনোযোগী হওয়ায় এখন তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে আমাদের যে সক্ষমতা সেটি একটি ভালো দিক। তবে এ সক্ষমতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারা আমাদের একটি ব্যর্থতা। আমরা বিদ্যুতের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী যেসব পরিকল্পনা করি সেটি রিভাইজ করি না। এ কারণে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাইরে এখন আমাদের স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার, যাতে এসব সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা যায়।