পানি-বাতাস-শব্দদূষণ: অস্বাস্থ্যকর ঢাকায় ভয়াবহ হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

পানি-বাতাস-শব্দদূষণ: অস্বাস্থ্যকর ঢাকায় ভয়াবহ হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

রয়েল ভিউ ডেস্ক :
গড়ে তোলা হচ্ছে একের পর এক অবকাঠামো। আশা একদিন উন্নত বিশ্বের শহরগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে মেগা সিটি ঢাকা। যদিও মৌলিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধাই নিশ্চিত করা যায়নি এখনো। যাপিত জীবন অস্বাস্থ্যকর। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে যানজট-মশা-ধোঁয়া-ধুলায়। ঢাকার সংকট-সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন। 

ঢাকার জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। রাজধানীমুখী মানুষের এ চাপ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। মেগাসিটি ঢাকা পিছিয়ে নেই দূষণেও। বাতাস ও শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষ নগরের তালিকায় নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে ঢাকার নাম। দূষণ ছড়িয়েছে নগরীর জলাধার, নদ-নদীতেও। পরিবেশদূষণে অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠা ঢাকার জনস্বাস্থ্য ভয়াবহ হুমকিতে পড়েছে।

প্রায় আড়াই কোটি মানুষের এ শহরে নিশ্চিত করা যায়নি পয়োনিষ্কাশন, নির্মল বায়ু, বিশুদ্ধ পানীয় জল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত প্রাথমিক ও অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। নির্মিত হচ্ছে বিশেষায়িত হাসপাতালও। স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত লোকবলের সংখ্যাও বেশি। রোগাক্রান্তদের জন্য সেবার অবকাঠামো থাকলেও রোগ প্রতিরোধ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়নি।

বিশুদ্ধ পানি, পয়োনিষ্কাশন, বায়ুদূষণ রোধ, পার্ক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছিল জাতীয় নগর স্বাস্থ্য কৌশলপত্র ২০১৪-তে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মতো শহরাঞ্চলেও শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরিতে গুরুত্ব দেয়ার কথাও এতে উল্লেখ ছিল। তবে বাস্তবে এসব কিছুই হয়নি রাজধানীতে। এক যুগ আগে নগর জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগকে দেয়া হয়। কিন্তু কিছু নিয়মমাফিক কাজের বাইরে তাদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ কাজে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাস্থ্য ইউনিট, কারিগরি সুবিধা, অবকাঠামো ও জনবল নেই।

জনবহুল এ শহরের বাসিন্দাদের মৌলিক পরিষেবা নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষ সক্ষম নয় বলেই উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যের রুটলেজ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায়। ঢাকার কঠিন বর্জ্যের মধ্যে ৩৮ শতাংশ এখনো ব্যবস্থাপনার আওতায় আসেনি। এসব বর্জ্য ড্রেন, রাস্তা ও গর্তে ফেলা হচ্ছে। ৪১ শতাংশ পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। বাসিন্দাদের ১০ শতাংশের প্রয়োজনীয় ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা থাকলেও ৩৮ শতাংশের ব্যবস্থাপনা দুর্বল।

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ঢাকার বাতাসে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড, মনোক্সাইড, সালফারসহ ভারী ধাতু, কণা ও বিষাক্ত গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে হাঁপানি, ক্যান্সার, হূদরোগ, ফুসফুসের ব্যাধিসহ বিভিন্ন রোগ। বছরে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ৫০ হাজার শিশুর মধ্যে ২৮ শতাংশের মৃত্যু হয় বায়ুদূষণের কারণে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গত বছর ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ শ্বাসযন্ত্রের রোগ নিয়ে এসেছিল। ভর্তি করা হয় ৬০ হাজারকে।

তথ্য বলছে, ঢাকা থেকে দৈনিক ৩৫০ টন বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে যাচ্ছে। অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা না থাকায় প্রায় ৯০ শতাংশ পয়োবর্জ্য খাল ও নদীতে পড়ছে। ফলে বিষাক্ত হয়ে পড়া পানি তৈরি করছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ঢাকার দুই সিটিতে খেলার মাঠেরও সংকট রয়েছে। প্রায় ১ হাজার ২০০ একর জমিতে খেলার মাঠ ও প্রায় ১ হাজার ৯০০ একর জমিতে পার্ক থাকার কথা থাকলেও পার্ক রয়েছে ২৭১ একর ও খেলার মাঠ রয়েছে ২৯৪ একর।

নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ও সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি চরম উপেক্ষিত উল্লেখ করে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন অ্যান্ড ফ্যামিলি হেলথের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমদ মোস্তাক রাজা চৌধুরী জানান, শহরাঞ্চলের জনস্বাস্থ্য কি স্থানীয় সরকার বিভাগ দেখবে নাকি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ দেখবে, এ বিষয়ের সুরাহা এখনো হয়নি। পৃথিবীর সব বড় শহরে সিটি গভর্নমেন্ট রয়েছে। আমরা সেসব দেখেও কিছু শিখতে পারিনি। নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা এখনো উপলব্ধিই করিনি। স্বাস্থ্য অবকাঠামোয় কিছুটা গুরুত্ব দিলেও নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের জন্য ব্যবস্থাপনা নেই। পার্ক, শিশুদের খেলার মাঠ, গণশৌচাগার, বিনোদনের ব্যবস্থা, ফুটপাতের সংকট রয়েছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য উপজীব্য বিষয়গুলো পরিকল্পনায় নেই। নগরায়ণ উন্নয়নের অংশ, তবে নগরায়ণ সঠিকভাবে হচ্ছে না।

ঢাকায় নগরায়ণ দ্রুত হলেও তা অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত। ফলে পানীয় জলের অভাব, দূষিত পানি, ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ ফুরিয়ে যাওয়া, পয়োনিষ্কাশনে বিপর্যস্ত শহরে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক কনটেন্ট প্লাটফর্ম ভয়েস অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বলছে, ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে না পানীয় জলের সরবরাহ। বস্তি এলাকায় সংকট বেশি। গত চার দশকে চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করতে পারেনি ওয়াসা। ২০২০ সালেও চাহিদার অর্ধেকের কম পানি সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে সেখানেও দেখা দিচ্ছে সংকট।


রাজধানীতে স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনা সীমিত থাকায় বাসিন্দারা বেসরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল। আয়ের ভিন্নতার কারণে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতেও রয়েছে বৈষম্যও। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সেন্টার ফর সাসটেইনেবল সিটিস বলছে, ঢাকা শহরের প্রতি হাজার জনসংখ্যার জন্য ৯ দশমিক ৩৭টি স্বাস্থ্য পরিষেবা রয়েছে। তবে এ পরিষেবার মধ্যে ৯৭ শতাংশই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। মৌলিক স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষ।

ঢাকার জলাশয়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সক্ষমতা কমেছে। ফলে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা ও বন্যা। ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ও ২০২১ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু। এর সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয় ঢাকা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বলছে, ২০১০-১৯ সালের মধ্যে ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় ২২ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অন্তত ১০ ফুট নিচে নেমেছে। জলাভূমির বিলুপ্তি ও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে আর্সেনিকের উচ্চ উপস্থিতি, পানিতে লবণাক্ততা, শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে ধূলিকণা, কণার উপস্থিতি ও তাপমাত্রা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, নগর অঞ্চলে প্রাথমিক ও অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তোলা যায়নি। এখানে বিশেষায়িত হাসপাতাল হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের জন্য ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালে আসার আগেই ব্যবস্থা নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে হাসপাতালের ওপর চাপ বাড়ে। একই সঙ্গে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। পানি জমছে, দূষণ হচ্ছে, যানজট বাড়ছে, অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ঢাকায় জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় গণশৌচাগার না থাকার করণে কিডনি রোগসহ নানা রোগের ঝুঁকি বেড়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে গণশৌচাগার রয়েছে মাত্র ১০৩টি। কোনো কোনো জায়গায় নারী ও শিশুদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা না থাকায় তারাই এ রোগের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পয়োনিষ্কাশন, পার্ক, খেলার মাঠ, নগর পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে আমাদের স্বতন্ত্র কাজ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবাই কাজ করে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো উপেক্ষিত রাখা হচ্ছে না। যে বিষয়গুলোর কথা বলা হয়েছে, তা একটি কর্তৃপক্ষের কাজ নয়। সবার সমন্বিত প্রয়াসে ঢাকাকে নাগরিকদের জন্য আদর্শ নগরী করা যায়।

নাগরিকদের জন্য ঢাকাকে পরিকল্পনামাফিক উপযোগী করা যায়নি উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনার অধ্যাপক ড. একেএম আবুল কালাম বলেন, ঢাকা অর্থনীতির জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। অর্থনীতির কথা চিন্তা করে আমরা যদি কোনো জায়গা খালি না রাখি তাহলে মানুষ সুস্থ থাকতে পারবে না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ শহরাঞ্চলে আরো গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শুধু ভবনই করে যাচ্ছি, কিন্তু ভবনের বাইরে যে সুন্দর পরিবেশ থাকা প্রয়োজন তা নিয়ে ভাবছি না। হাঁটাচলা, পার্ক এসব সুবিধা রাখছি না। পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে সেসব বাস্তবায়নও গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বণ্টন বৈষম্যপূর্ণ। পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দূষণ রোধ, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা আদর্শ নগরের মুখ্য বিষয়।