পশ্চিমাদের নতুন মাথাব্যথা কারণ ইরানি ‘সুইসাইড’ ড্রোন!

পশ্চিমাদের নতুন মাথাব্যথা কারণ ইরানি ‘সুইসাইড’ ড্রোন!

রয়েল ভিউ ডেস্ক:

রাশিয়ার ক্রুজ মিসাইলগুলোর প্রতিটির জন্য খরচ পড়ে ৪০ লাখ থেকে এক কোটি ৪০ লাখ ডলারের মতো। অন্যদিকে একটি গেরান-২ ড্রোন তৈরি করতে ব্যয় হয় মাত্র ২০,০০০ ডলার। রাশিয়ার ড্রোন ব্যবহারের এটিও একটি বড় কারণ।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে গত কয়েক মাস আগেও দাপট দেখিয়েছিল তুরস্কের তৈরি বায়ারাকতার ড্রোন। তবে এবার যেন পাশার দান বদলে গেছে, রাশিয়া এখন প্রচুর পরিমাণে 'কামিকাজে ড্রোন' ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে এ আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে রাশিয়া।

ইরানের তৈরি রাশিয়ার নতুন প্রিয় এ ড্রোনটির ইরানি নাম 'শহীদ ১৩৬'। তবে রাশিয়ানরা এটিকে ব্যবহার করছে গেরান-২ হিসেবে। দামে সস্তা এ ড্রোনগুলো নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। তবে এ ড্রোনগুলো ওড়ার সময় মাত্রাতিরিক্ত শব্দ করে বলে এগুলো খুব সহজেই আকাশেই চিহ্নিত করা যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি পাইলটেরা তাদের বিমান নিয়ে মিত্রপক্ষের জাহাজ, রণতরী, বা অন্যান্য স্থাপনার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এভাবে শত্রুকে হত্যা করে তারা নিজেরাও আত্মহত্যা করতেন। এ পাইলটেরা কামিকাজে পাইলট নামে পরিচিত ছিলেন। সচরাচার ড্রোন থেকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে মিসাইল বা অন্য কোনো বিস্ফোরক ছোঁড়া হলেও কামিকাজে ড্রোনগুলো নিজেরাই লক্ষ্যবস্তুর ওপর দ্রুতবেগে পতিত হয়ে বিস্ফোরিত হয়।

রাশিয়া এ আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করে একাধিক লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছে। ভ্লাদিমির পুতিনের ইচ্ছে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা, দেশটির জনগণ ও সেনাবাহিনীর মনোবল নিঃশেষ করা এবং ইউক্রেনীয় বাহিনীর এ ড্রোন ধ্বংস করার চেষ্টার মাধ্যমে ইউক্রেনের অস্ত্র-সক্ষমতা কমিয়ে আনা।

বিভিন্ন প্রকারের সামরিক ড্রোন আছে বিশ্বব্যাপী। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোনগুলো বিশ্বের কাছে বেশি পরিচিত। এসব ড্রোন মিসাইল নিক্ষেপ করার পর ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। রাশিয়ার গেরান-২ ড্রোনগুলো বিস্ফোরকে ভর্তি থাকে। এগুলোর প্রোগ্রামে আগে থেকেই লক্ষ্যবস্তুর জিপিএস ঠিকানা দেওয়া থাকে। এরপর লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর তীর্যকভাবে তীব্রগতিতে নেমে এসে বিস্ফোরিত হয় গেরান-২।

গেরান-২ ড্রোনের ভর প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম। এটির ইঞ্জিনের ক্ষমতা ৫০ অশ্বশক্তি। আর ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে এটি। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিজ-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো বেহনাম বেন টালেব্লু'র তথ্যমতে এর আগে ইয়েমেনে একটি ট্যাংকার হামলায় শাহেদ ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল।

স্প্যানিশ গণমাধ্যম এল পাইস-এর গত সপ্তাহের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয় বাহিনীও রাশিয়ার ড্রোনের কড়া প্রত্যুত্তর দিচ্ছে। কেবল গত ১১ অক্টোবরই ১০টি শাহেদ ১৩৬ ড্রোন ভূপাতিত করেছে ইউক্রেনীয়রা। ইউক্রেনিয়ান জেনারেল স্টাফ-এর দাবি অনুযায়ী, দেশটির আকাশসীমায় পৌঁছানো রাশিয়ান এ 'কিলার ড্রোন'গুলোর ৬০ শতাংশই তারা ধ্বংস করেছে।

২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর কিয়েভে হামলার সময় জনৈক ইউক্রেনীয় সশস্ত্র সদস্য গুলি করে ড্রোন ভূপাতিত করার চেষ্টা করছেন। 

পেন্টাগনের সূত্র জানিয়েছে, তেহরান দেশটিকে 'বিভিন্ন ধরনের শয়ে শয়ে ড্রোন সরবরাহ করেছে।' এ ড্রোনগুলোর মধ্যে মোহাজের-৬ নামক রেকি ও আক্রমণ করার ড্রোনও রয়েছে। ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে রাশিয়া ইরান থেকে ২,৪০০টির মতো ড্রোন অর্ডার করেছে। রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, ইরান রাশিয়াকে ভূমি থেকে ভূমিতে উৎক্ষেপণযোগ্য মিসাইল এবং আরও ড্রোন সরবরাহের জন্য গত ৬ অক্টোবর একটি চুক্তির বিষয়ে সম্মত হয়েছে।

ওয়াশিংটনের আরেকটি থিংক ট্যাংক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট-এর সিরিয়া যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ অ্যান্টন মার্দাসোভা মনে করেন, বিশ্বের অন্যান্য শক্তির তুলনায় রুশ বাহিনীর সবচেয়ে কম অগ্রসর সামরিক সক্ষমতার ক্ষেত্রগুলোর একটি হচ্ছে ড্রোনযুদ্ধ। রাশিয়ান বাহিনী নজরদারি ও আর্টিলারিকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য অনেক ড্রোন ব্যবহার করে। তবে দেশটির অ্যাটাক ড্রোনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার গণমাধ্যম তাস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক ইগর ইশুক বলেছিলেন, 'প্রযুক্তি ও কৌশলগত চাহিদা মেটাতে সক্ষম এমন ড্রোন তৈরি করে না রাশিয়া।' এদিকে চীনও বর্তমানে রাশিয়াকে যথেষ্ট পরিমাণে ড্রোন সরবরাহ করছে না।

২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। ওই যুদ্ধে তেহরানের বাহিনীর সঙ্গে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে পাশাপাশি লড়েছিল রাশিয়ান সশস্ত্রবাহিনী। সিরিয়াতে রাশিয়ানরা ড্রোন ব্যবহার করেছিল। আর এসব ড্রোনের পাইলটেরা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন ইরানে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ন্যাটোর গোয়েন্দারা জানতে চাচ্ছে রাশিয়ার কাছে আর কতগুলো ক্রুজ মিসাইল বাকি আছে। গত জুনে দ্য ইকোনোমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল, কেবল দু সপ্তাহে রাশিয়া যে পরিমাণ আর্টিলারি নিক্ষেপ করেছিল তা মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর সর্বমোট বার্ষিক উৎপাদনের সমান।

ইউক্রেন বিমানবাহিনীর মুখপাত্র ইউরি ইনাত বলেছেন, 'রাশিয়া যে শহীদ ১৩৬ ও ১২৯ এবং মোহাজের-৬ ব্যবহার করছে, তা স্পষ্ট নির্দেশ করে তারা বর্তমানে কেএইচ-১০১, কালিবার ও কেএইচ-৫৫ (দূরপাল্লা) মিসাইলের ঘাটটিতে ভুগছে।'

রাশিয়ার ক্রুজ মিসাইলগুলোর প্রতিটির জন্য খরচ পড়ে ৪০ লাখ থেকে এক কোটি ৪০ লাখ ডলারের মতো। অন্যদিকে একটি গেরান-২ ড্রোন তৈরি করতে ব্যয় হয় মাত্র ২০,০০০ ডলার। রাশিয়ার ড্রোন ব্যবহারের এটিও একটি বড় কারণ।

তবে গেরান-২-এর বড় একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ ড্রোনগুলো আর্টিলারির ওপর সফলভাবে হামলা চালাতে পারে না। এগুলো কেবল স্থির লক্ষ্যবস্তুর ওপরই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। ড্রোনটির পাল্লা ১০০০ কিলোমিটার হলেও ইউক্রেনে জিপিএস গাইডেন্স সিস্টেমের কারণে এটিকে কম পাল্লায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

বর্তমানে রাশিয়া ট্রাকের ওপর বসানো লাঞ্চার থেকে এ ড্রোনগুলোকে আকাশে ওড়াচ্ছে। এগুলো নিচু হয়ে ও ধীরগতিতে যেতে পারে বলে সহজেই রেডারের নজর এড়াতে পারে। তবে যেখানে নিয়মিত মিসাইলে ৪৮০ কেজির মতো বিস্ফোরক থাকে, সেখানে গেরান-২ ড্রোন কেবল ৪০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে পারে। এর ফলে এগুলো ব্যবহার করে শক্তিশালী ও বড়সড় লক্ষ্যবস্তুর খুব বেশি ক্ষতিসাধন করা সম্ভব নয়।

সূত্র: এল পাইস, দ্য টাইমস অব ইজরায়েল, রয়টার্স