শারদীয় দুর্র্গোৎসব ॥ সিলেট  বিভাগে ২৭৭০টি মন্ডপে পূজা 

শারদীয় দুর্র্গোৎসব ॥ সিলেট  বিভাগে ২৭৭০টি মন্ডপে পূজা 

সুনীল সিংহ ঃ 
দরজায় কড়া নাড়ছে শারদীয় পূজো। ক’দিন পরই শুরু হবে শারদীয় দুর্গোৎসব। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। শরৎকালে এই পূজা হয় বলে একে শারদীয় দুর্গোৎসব বলা হয়। দুর্গোৎসবকে ঘিরে সিলেটের সর্বত্র চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। আর কয়েকদিনের মধ্যেই পূজার জন্য প্রতিমা মন্দিরে স্থাপন করা হবে। 
এদিকে, দুর্গাপূজা সন্নিকটে বলে কারিগররা ব্যস্ত মূর্তি সাজাতে। আর পূজা কমিটিগুলো ব্যস্ত পূজার স্থান নির্ধারণসহ আনুষঙ্গিক কাজে। অনেকেই মূর্তি বানানোর জন্য দেশের নামকরা প্রতিমা নির্মাতা শিল্পীদের সাথে চুক্তি করে কাজ করাচ্ছেন। প্রতিমা নির্মাতা শিল্পীরা এখন মূর্তির উপর রং তুলির কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। 
শিল্পীদের রঙিন তুলির আঁচড়ে প্রতিমাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠবে। মহানগরীর পাশাপাশি মফস্বল এলাকায়ও পূজা কমিটিগুলো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টায় কাজ করছেন দিনরাত। 
পঞ্জিকা মতে এবার দেবীর ঘোটকে আগমন আর ঘোটকে গমন। ২০ অক্টোবর শুক্রবার সায়ংকালে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হবে। ২৪ অক্টোবর মঙ্গলবার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে উৎসব শেষ হবে। শরতের শুক্লপক্ষে ভক্তের অকাল বোধনে মা দুর্গা- লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, কলা বৌ এবং সবার উপরে শিবকে নিয়ে সপরিবারে আসছেন। সাথে থাকবে অসুর, দুর্গার বাহন সিংহ, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, সরস্বতীর বাহন শ্বেতহংস, কার্তিকের বাহন ময়ূর ও গণেশের বাহন ইঁদুর।
বিশ্বের সকল শক্তির মিলিত রূপ শ্রীশ্রী দুর্গা। শিব, দুর্গা বা কালী সব একই শক্তি। ঈশ্বরের মাতৃরূপ শ্রীশ্রীদুর্গার মধ্যে বিদ্যমান। এই মহাশক্তির আরাধনায় দেবীকে বিভিন্ন রূপে বন্দনা করা হয়। শ্রীশ্রী চন্ডী গ্রন্থে দেবীর নয়টি রূপের কথা উল্লেখ আছে। যা নবদুর্গা নামে আখ্যায়িত। রূপগুলো হলো শৈলীপুত্র, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, কুষ্মান্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রী, মহাগৌরী ও সিদ্ধিদাত্রী। এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। 
দেবী দুর্গার যে মূর্তি সচরাচর দেখা যায়- সেটি সপরিবারে দেবী দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যে দেবী দুর্গা সিংহ বাহিনী ও মহিষাসুর মর্দিনী। দেবীর ডান দিকে উপরে লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ। বাঁ দিকে উপরে সরস্বতী ও নিচে কার্তিক। সেই সাথে রয়েছে তাদের বাহন পেঁচা, ইঁদুর, হংস ও ময়ূর। আর দেবীর কাঠামোর উপরে শিবের মূর্তি স্থাপন করা হয়। 


প্রতিমা শিল্পীরা জানান, ‘এখন তো দম ফেলবার ফুরসত নেই। শেষ সময়ে এসে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। রঙের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন প্রতিমার গায়ে পোশাক জড়ানোর কাজ চলছে।’
প্রতিমা নির্মাণ শিল্পীদের মতোই ব্যস্ত সময় পার করছেন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নির্মাণ শিল্পীরা। দুর্গাপূজায় ঢাক-ঢোল, মৃদঙ্গসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের যেমন বাড়তি চাহিদা থাকে, তেমনি মেরামতের প্রয়োজনেও অনেক বাদ্যযন্ত্রী ভিড় করছেন এসব যন্ত্রের দোকানে।
এবছর সিলেট বিভাগে পারিবারিক, বারোয়ারি ও সর্বজনীন পূজামন্ডপ (স্থায়ী ও অস্থায়ী) ২৭৭০টি। পুরো বিভাগে গত বছর থেকে এবার ৩৭টি পূজোমন্ডপ বেশি। আর বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পূজা মৌলভীবাজার জেলায় ১০৩৬টি।
গত বছর ছিল সিলেট বিভাগে পারিবারিক, বারোয়ারি ও সর্বজনীন পূজোমন্ডপ (স্থায়ী ও অস্থায়ী) ২৭৩৩ টি। 
এবার সিলেট মহানগর ও জেলায় ৬১৭টি ম-পে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বজনীন ৫৬৯টি, পারিবারিক ৪৮টি পূজোর আয়োজন করা হবে। যা গত বছর থেকে এবার ৬টি বেশী। 
মহানগরীতে ১৫১টি পূজার মধ্যে সর্বজনীন ১৩৪টি ও পারিবারিক ১৭টি। জেলায় ৪৬৬টি পূজার মধ্যে সর্বজনীন ৪৩৫টি ও পারিবারিক ৩১টি।
জানা গেছে, মহানগরীর ৬টি থানা এলাকায় এবার মোট ১৫১টি পূজামন্ডপে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। কোতোয়ালি থানা এলাকায় ৩৯টি, জালালাবাদ থানা এলাকায় ১৮টি, এয়ারপোর্ট থানা এলাকায় ৩৮টি, শাহপরান (রহ:) থানা এলাকায় ২৩টি, দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকায় ১৫টি ও মোগলাবাজার থানা এলাকায় ১৮টি।


আর জেলায় মোট ৪৬৬টি মন্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বজনীন ৪৩৫টি ও পারিবারিক ৩১টি। জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ৬৬টি, বালাগঞ্জ উপজেলায় ৩২টি, কানাইঘাট উপজেলায় ৩১টি, জৈন্তাপুর উপজেলায় ২৩টি, বিশ্বনাথ উপজেলায় ২৫টি, গোয়াইনঘাট উপজেলায় ৩৯টি, জকিগঞ্জ উপজেলায় পূজা ৯৮টি, বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৫০টি, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ২৮টি, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ৪০টি এবং ওসমানীনগর উপজেলায় ৩৪টি পূজা অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া, মৌলভীবাজার জেলায় ১০৩৬টি পূজার আয়োজন করা হয়েছে। গতবছর থেকে এবার ৩০টি পূজা বেশি। এর মধ্যে মৌলভীবাজার পৌরসভায় ও সদর উপজেলায় ১১৭টি। এর মধ্যে ৯৪টি সর্বজনীন ও ২৩টি পারিবারিক। শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ১৭৩টি। এর মধ্যে ১৫৮টি সর্বজনীন ও ১৫টি পারিবারিক। বড়লেখা উপজেলায় ১৫৩টি। এর মধ্যে ১৪০টি সর্বজনীন ও ১৩টি পারিবারিক। জুড়ী উপজেলায় ৭১টি। এর মধ্যে ৬৮টি সর্বজনীন ও ৩টি পারিবারিক। রাজনগর উপজেলায় ১৩৮টি। এর মধ্যে ৭৭টি সর্বজনীন ও ৬১টি পারিবারিক। কমলগঞ্জ উপজেলায় ১৬২টি। এর মধ্যে ১৪৬টি সর্বজনীন ও ১৬টি পারিবারিক ও কুলাউড়া উপজেলায় সর্বোচ্চ ২২২টি। এর মধ্যে ২০৩টি সর্বজনীন ও ১৯টি পারিবারিক পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জে এবার ৪২৫টি পূজার আয়োজন করা হয়েছে। গতবছর থেকে ১টি পূজা বেশি। গত বছর পূজা ছিল ৪২৪টি। এবারের পূজার মধ্যে সুনামগঞ্জ পৌরসভায় ২৫টি সর্বজনীন, সদর উপজেলায় ২১টি সর্বজনীন ও ২টি পারিবারিক, ছাতক পৌরসভায় ১২টি সর্বজনীন, ছাতক উপজেলায় ২২টি সর্বজনীন, জগন্নাথপুর পৌরসভায় ৫টি সর্বজনীন ও ১টি পারিবারিক, জগন্নাথপুর উপজেলায় ৩২টি সর্বজনীন ও ৪টি পারিবারিক, দিরাই পৌরসভায় ৭টি সর্বজনীন, দিরাই উপজেলায় ৫৯টি সর্বজনীন ও ২টি পারিবারিক, শান্তিগঞ্জ উপজেলায় ২২টি সর্বজনীন ও ২টি পারিবারিক, জামালগঞ্জ উপজেলায় ৪৪টি সর্বজনীন ও ২টি পারিবারিক, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ২৯টি সর্বজনীন, শাল্লা উপজেলায় ২৯টি সর্বজনীন ও ৩টি পারিবারিক, তাহিরপুর উপজেলায় ২৭টি সর্বজনীন ও ২টি পারিবারিক,  দোয়ারাবাজার উপজেলায় ১৯টি সর্বজনীন, ধর্মপাশা উপজেলায় ২০টি সর্বজনীন ও ১টি পারিবারিক ও মধ্যনগর উপজেলায় ৩৩টি সর্বজনীন পূজার আয়োজন করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলায় এবারও ৬৯২টি পূজার আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জ পৌরসভায় ৩৫টি সর্বজনীন ও ১টি পারিবারিক, সদর উপজেলায় ৪২টি সর্বজনীন, শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভায় ৮টি, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় ১২টি, লাখাই উপজেলায় ৭০টি, আজমিরিগঞ্জ পৌরসভায় ৮টি, আজমিরিগঞ্জ উপজেলায় ২৯টি, বানিয়াচং উপজেলায় ১২৭টি, চুনারুঘাট পৌরসভায় ৪টি সর্বজনীন ও ৪টি পারিবারিক, চুনারুঘাট উপজেলায় ৭১টি সর্বজনীন ও ৭টি পারিবারিক, মাধবপুর পৌরসভায় ১৩টি, মাধবপুর উপজেলায় ১০৭টি, বাহুবল উপজেলায় ৫৪টি, নবীগঞ্জ পৌরসভায় ১০টি ও নবীগঞ্জ উপজেলায় ৮৯টি পূজার আয়োজন করা হয়েছে।


বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এডভোকেট মৃত্যুঞ্জয় ধর ভোলা শারদীয় দুর্গোৎসব সুষ্ঠু, সুন্দর ও সফল করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া, সকল পূজা মন্ডপে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য নিজস্ব জেনারেটর ও নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ভলান্টিয়ার রাখার কথা বলেছেন। 
মহানগরীর পূজামন্ডপগুলোর মধ্যে আকর্ষণীয় হলো রামকৃষ্ণ মিশন, বলরাম জিউড় আখড়া, কাজলশাহ, গোপালটিলা, মাছুদিঘিরপারের ত্রিনয়নী, দাঁড়িয়াপাড়ার চৈতালী, সনাতন যুব ফোরাম, লামাবাজার তিন মন্দির, রাজবাড়ী, যতরপুর, চালিবন্দর, মাছিমপুর, তোপখানা, গোটাটিকর শিববাড়ি ও করের পাড়ার শাপলা সংঘ।