হাওরাঞ্চলে দন্ত চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার জাল

হাওরাঞ্চলে দন্ত চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার জাল

# স্বাস্থ্য বিভাগের ভূমিকা রহস্যজনক
# দন্ডিত হওয়ার পরও থেমে নেই

 কাউসার চৌধুরী

বিজন হাওলাদার। দন্ত চিকিৎসা বিষয়ে কোনো মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেননি। কিন্তু দন্ত চিকিৎসক হিসেবে বছরের পর বছর ধরে চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। এমন অভিযোগে এলিট ফোর্স র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে কারাদ- দেন। আট বছর আগে ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক দন্ডিত হয়ে কারাভোগ করলেও বিজন হাওলাদার থেমে নেই। প্রকাশ্য দিবালোকে সেই আগের চেয়ে আরও দাপটের সাথে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে দন্ত চিকিৎসার নামে চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ কারবার।


আর জেলার তাহিরপুরে কোনো ধরনের ডিগ্রি ছাড়াই দন্ত চিকিৎসার নামে অবৈধ কারবার করছেন আব্দুল হান্নান নামের আরেক ব্যক্তি। হবিগঞ্জ জেলা সদরে বিশ্বজিৎ আচার্য্য দন্ত চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। মেডিকেল কলেজে ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস) ডিগ্রি ছাড়াই হাওরাঞ্চলে দন্ত চিকিৎসার নামে এ সকল ভুয়া দন্ত চিকিৎসক অপচিকিৎসার কারবার করছেন। আর সাধারণ লোকজন তাদের অপচিকিৎসার জালে আটকা পড়ছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক দন্ডিত হয়ে কারাভোগের পরও এরা আগের তুলনায় এখন আরও বেপরোয়া। বছরের পর বছর ধরে এভাবে সাইনবোর্ড টানিয়ে চেম্বার করে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করলেও এক্ষেত্রে রহস্যজনক নীরব ভূমিকা পালন করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এমনকি প্রশাসনের কেউই তাদের ব্যাপারে খোঁজ খবরও নেননি। ভুক্তভোগী লোকজনের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।


স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক ডা. হারুন অর রশিদও ভুয়া দন্ত চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি স্বীকার করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সিলেটের ডাককে তিনি বলেন, আমাদের দেশে ভুয়া ডাক্তারের অভাব নেই। এদের সংখ্যা অনেক বেশি। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে চেম্বার করছে। এ বিষয়ে সংবাদপত্রে লেখা হলে জনসাধারণ সচেতন হবেন। ভুয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। দন্ডিত হওয়ার পরও আইনের ফাঁকে এরা বেরিয়ে এসে আবারও সেই পুরনো অপকর্মে লিপ্ত হয়। ভুয়া দন্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
স্থানীয় লোকজন জানান, সুনামগঞ্জের দিরাই পৌর শহরের সেন মার্কেটে আব্দুল্লাহ এন্ড ইব্রাহিম ডেন্টাল কেয়ার, বিজন হাওলাদার ডেন্টাল কেয়ার, জাকারিয়া ম্যানশনে দিপা ডেন্টাল কেয়ার, মুন্নি এন্ড নোহা ডেন্টাল কেয়ার, পোস্ট অফিস রোডে বিমল ভূষণ দাস নামের ডেন্টাল কেয়ার, সেইফ ডেন্টাল কেয়ারসহ বিভিন্ন নামে ভুয়া চিকিৎসকরা বছরের পর বছর ধরে দন্ত চিকিৎসা করছেন। এ সব ডেন্টাল কেয়ারে দাঁতের স্কেলিং, দাঁতের ফিলিং, দাঁত তোলা, দাঁত বাঁধানোসহ দাঁতের নানান রোগের চিকিৎসা করা হয়।
২০১৫ সালের ৩১ মে রোববার দিরাইয়ে ভুয়া দন্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ অভিযান চালায় র‌্যাব। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট সম্রাট খীসার নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে ভুয়া দন্ত চিকিৎসক নুর মোহাম্মদ, বিজন হাওলাদার, মিঠুন কান্তি দাস তপন, লোকমান মিয়া ও হারুন অর রশিদকে আটক করা হয়। পরে নুর মোহাম্মদকে ৬ মাসের কারাদ- ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ মাসের কারাদ-, বিজন হাওলাদারকে ৪ মাসের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ মাসের কারাদ-, মিঠুন কান্তি দাস তপনকে ৬ মাসের কারাদ- ৩০ হাজার জরিমানা অনাদায়ে ১ মাসের কারাদ-, লোকমান মিয়াকে ৬ মাসের কারাদ- ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ মাসের কারাদ- এবং হারুন অর রশিদকে ৬ মাসের কারাদ- ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ মাসের কারাদ- দেয়া হয়। দন্ডিত হয়ে কারাভোগের পরও বর্তমানে তারা নিজ নিজ ডেন্টাল কেয়ারে সেই আগের মতো স্বাভাবিকভাবেই দন্ত চিকিৎসা করছেন।


জেলার তাহিরপুরের বাদাঘাট কলেজ রোডে টানা ২৩ বছর ধরে দন্ত চিকিৎসা করে যাচ্ছেন আব্দুল হান্নান নামের আরেক ভুয়া দন্ত চিকিৎসক। দন্ত চিকিৎসা বিষয়ক কোনো ডিগ্রি ছাড়াই তিনি দন্ত চিকিৎসা করছেন। কোনো সময় তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মুখোমুখিও হতে হয়নি।


হবিগঞ্জ জেলা সদরের বদিউজ্জামান খাঁন সড়কে বিশ্বজিৎ আচার্য্য নামের আরেক ভুয়া দন্ত চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। বিডিএস ডিগ্রিধারী না হয়েও তিনি প্রকাশ্য দিবালোকে সাইনবোর্ড টানিয়ে দন্ত চিকিৎসা করছেন। এই ভুয়া দন্ত চিকিৎসকের কাছে প্রতারণার শিকার হওয়া এক রোগী জেলা সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগও দেন।
এদিকে, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা সদরে শামছুল আলম নামের এক ভুয়া দন্ত চিকিৎসক ডেন্টিস্ট সম্পর্কিত কোন কোর্স না করেই দন্ত চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। কেবল চিকিৎসা নয় দাঁতে অস্ত্রোপচারের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ও স্বাভাবিকভাবেই করছেন এ সকল ভুয়া দন্ত চিকিৎসকরা। গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল রোগীদের টানতে সাঁটানো হয়েছে চকচকা সাইনবোর্ডও।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, একজন দন্ত রোগীকে চিকিৎসা দিতে হলে চিকিৎসককে অবশ্যই ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি বা বিডিএস পাশ করতে হবে। এমবিবিএস’র মতো বিডিএস ডিগ্রির জন্যেও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করতে হয়। একটানা ৫ বছর পড়াশোনার পর বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর বিডিএস ডিগ্রি অর্জন করা হয়। কিন্তু এই বিডিএস ডিগ্রি অর্জন না করেই হাওরাঞ্চলে ভুয়া দন্ত চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।