স্মৃতিচারণ: আব্বাকে মনে পড়ে
ডা. আরমান আহমদ শিপলু ::
বাবা সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়, সন্তানের নিশ্চিন্ত নিঃসংকোচ ভরসার নাম বাবা। আমরা দুই ভাই-এক বোন। আমাদের কাছে আব্বা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, সবচেয়ে ভালো এক মানুষ। এমন এক বাবার সন্তান হতে পেরে আমরা ধন্য। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আমরা প্রাণভরে শুকরিয়া জানাই।
আমার বেড়ে ওঠা জনকোলাহলপূর্ণ এক বাড়িতে, একান্নবর্তী পরিবারের সন্তান হিসেবে বড় হয়েছি। বাংলাদেশের পূণ্যভূমি, আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের ছড়ারপাড় মহল্লা আমাদের পূর্ব পুরুষদের আদি নিবাস; সেখানেই আমাদের জন্ম, সেখানেই আমদের বসবাস। ছোটবেলা থেকেই আমি দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে মানুষের অবাধ চলাচল। শিশু অবস্থায় মিছিল, সভা বা শ্লোগান বুঝতাম না। মাঝে মাঝে দেখতাম জানালার ফাঁক দিয়ে বা দরজায় দাঁড়িয়ে মানুষের সংঘবদ্ধ বিচরণ। চা, বিস্কুট, খিচুড়ি, মুড়ি চাটনি, মটর পোলাও দিয়ে সারাদিনই মানুষের আপ্যায়ন করা হতো। মিছিল শ্লোগানে ছোট্ট আমি তখন দাদা-দাদুর কাছে ভয়ে আশ্রয় খোঁজতাম। দাদা আমাকে অভয় দিতেন। এতো মানুষের মাঝখানে কিন্তু আব্বাকে দেখতে কোনো অসুবিধা হতো না। শ্বেত শুভ্র সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পড়া আব্বাকে খুব সহজেই চেনা যেতো।
আব্বা তিনবার সিলেট পৌরসভার তোপখানা ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন। দু’বার আমার জন্মের পূর্বে, শুধুমাত্র আব্বার ১৯৮৯ সালের কমিশনার নির্বাচন আমি দেখেছি। আব্বা হাসি-খুশি থাকতে পছন্দ করতেন। মানুষের জন্য কাজ করতে ভালবাসতেন। মানুষের জন্য কাজ করতে আব্বার ক্লান্তি হতো না। আব্বা কয়েক মাসের জন্য প্রবাস জীবনে ছিলেন। তখন যোগাযোগ চিঠি বা ল্যান্ডফোনের মাধ্যমেই হতো। একটা ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে, আমার বয়স যখন চার বা পাঁচ বছর তখন ক্যাসেট রেকর্ডারে আমার কথা রেকর্ড করে আব্বাকে পাঠানো হয়েছিলো। তার কিছুদিন পর আব্বাও কথা রেকর্ড করে আমাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আব্বা দেশের ভেতরে বা বাইরে যখনই গেছেন প্রতিবারই পরিবারের সবার জন্য কিছু না কিছু উপহার থাকত। যৌথ পরিবারে অনেক সদস্যের বাস, সবার জন্যই আব্বা একটা কিছু নিয়ে আসতেন। জনসেবা করতে গিয়ে আব্বাকে কখনো ক্লান্ত বা বিরক্ত হতে দেখিনি।
পরিবারের সদস্যদের উপর নির্দেশ ছিল মানুষ কোনো কাজে আসলে সাথে সাথে যেনো আব্বার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। জীবনে কতোবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাবাকে মানুষের কাজে ডেকে দিয়েছি তার কোনো হিসেব নেই। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্থ একনিষ্ঠকর্মী ছিলেন আব্বা। একটা ঘটনা আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।
আমি সম্ভবত তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র, ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে আমাদের বাড়িতে আব্বা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ মাইকে বাজিয়েছিলেন। জাতীয় শোক দিবসের ইতিহাস তখনও আমার জানা ছিলো না। আমি হঠাৎ লক্ষ করলাম আব্বা কাঁদছেন। আমি আব্বার কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলাম। আব্বা তখন তখন আমাকে পাশে বসিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলছিলেন এই মহান নেতা আমাদের দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহে স্বাধীন দেশে সপরিবারে এই নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তখন এরশাদ সরকারের শাসনামল চলছিল। দেশে মানুষের ভোট ও মতের অধিকার ছিল না। আব্বা তখন সিলেট শহরের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
নগরীর তালতলায় সম্ভবত শহর আওয়ামী লীগের কার্যালয় ছিল। একদিন বিকেলে আমরা চাচাতো ভাই বোনেরা বাড়ির আঙ্গিনায় খেলছি। হঠাৎ দেখি আব্বা বাড়িতে আসলেন, অনেকটা তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে ঢুকলেন। লক্ষ করলাম আব্বার পায়ে কোনো জুতা নেই। আম্মার কাছ থেকে জানতে পারলাম পুলিশ আওয়ামী লীগের মিছিলে লাঠিচার্জ করেছে, দফায়-দফায় ধাওয়া করেছে। অনাকাক্সিক্ষত পুলিশী হয়রানি বা গ্রেফতার এড়াতেই জুতো রেখে দৌঁড়ে দৌঁড়ে বাড়িতে এসেছেন আব্বা। আমার জন্মের প্রায় এগারো বছর পর আমার বোনের জন্ম, তারও পাঁচবছর পর আমার ভাই পৃথিবীতে এসেছে। আমাকে কোলে নিয়ে আব্বা-আম্মা একটা গান প্রায়ই গাইতেন। গানটির কথাগুলো ছিল ‘আমরা দুটি ছেলে মেয়ে, শিপলুরে তুই বাপ’।
এক সন্ধ্যার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। এরশাদ সরকারেরে বিরুদ্ধে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আমাদের বাড়িতে আওয়ামী লীগের সভা চলছিল। হঠাৎ এক ভদ্রলোক এসে একটা সংবাদ দিলেন। আর্মির গাড়ি কালিঘাট অতিক্রম করে আমাদের বাড়ির দিকে এগুচ্ছে। মূহুর্তেই বাড়িটা তখন নেতাকর্মীশূন্য হয়ে পড়লো। যে যেভাবে পেড়েছেন গ্রেপ্তার এড়াতে দৌঁড়ে আমাদের বাড়ির স্থান ত্যাগ করেছেন। আমার আম্মা ও দাদী বারবার আব্বাকে সরে যেতে বলছিলেন। কিন্তু আব্বা সরে না গিয়ে মূল দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম এবং হেডলাইটের আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। শেষমেষ দেখা গেলো এটা আর্মির গাড়ি ছিল না। একটা ট্রাক্টর আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে পণ্য বোঝাই করে যাচ্ছিলো। এই অবস্থা দেখে তখন হাসির রোল পড়েছিল পুরো বাড়িতে। আমার দাদা ছিলেন সরকারি চাকুরীজীবি। আমার আব্বারা চার ভাই-পাঁচ বোন ছিলেন। দাদা দাদীর কাছে গল্প শুনেছি আব্বা ছোটবেলায় বাড়ির সব ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে নির্বাচন নির্বাচন খেলতেন। দুধের বড় টিনের কৌটা ব্যালট বাক্স হিসেবে বানাতেন। ব্যালট হিসেবে সাদাকাগজে নাম লিখা হতো। নির্বাচন শেষে বাড়ির ও আশেপাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মিছিল হতো। ভোটার ছিলেন বাড়ির সকল ছেলে-মেয়ে ও আশেপাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েরা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আব্বা জনমত তৈরিতে সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। তখন আমার দাদী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার তৈরি করে দিতেন এবং আব্বা এই খাবারগুলি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। আব্বা সাদামাঠা জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। সুগন্ধি ব্যবহার করতে খুব পছন্দ করতেন। পোষাক আশাকে পরিপাটি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ