পঞ্চাশ বছরেও তালিকায় নাম উঠলো না মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের

পঞ্চাশ বছরেও তালিকায় নাম উঠলো না মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের

 আহমাদ সেলিম ::

স্বামীর নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমেনা খাতুন দুইযুগের বেশী সময় চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। বারবার চেষ্টা করে পেয়েছেন শুধু প্রতিশ্রুতি। তারপর  তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে একসময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। পঞ্চান্ন বছরের কাছাকাছি এসে এখন সেই হাল ধরেছেন সেই নারীর বৃদ্ধ সন্তান, অর্থাৎ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মেজো ছেলে মো. হাসান মিয়া। 

গল্পের মতোই এক একটি মুক্তিযোদ্ধার জীবন। যে গল্প অনেক সময় পাথর চোখেও অশ্রুঝরায়। সিলেটের ডাক-এর বার্তা কক্ষে হাসান মিয়া না আসলেও হয়তো সেটি অজানাই থেকে যেতো। 

হাসান মিয়া একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন, সিলেট নগরীর মেজরটিলা এলাকায়। পেশায় তিনি হকার, পথে পথে ফেরি করেন পুরনো কাপড়। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো। বড় ভাই ২০১৮ সালে মারা যান। জীবিত আছেন ছোট একভাই, একবোন। মারা যাবার আগে বড় ভাই আবুল হোসেনও মুক্তিযোদ্ধা বাবার নামটি তালিকায় দেখে যাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার ভাগ্যে সেটি জুটেনি। এখন চেষ্টা করছেন হাসান মিয়া। এভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিষ্ঠা করতে একটি পরিবারের একের পর এক চেষ্টা, তারপর ব্যর্থতার গল্প তাদের সন্তানদেরও হতাশ করছে।

তাদের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের পেকপাড়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় লক্ষ্মীপুর ছিলো ইউনিয়নের নাম। সেই পেকপাড়ার একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম নূর মোহাম্মদ। যিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সহযোদ্ধারা  গ্রামে ফিরে এলেও ফিরে আসেননি শুধু নূর মোহাম্মদ। 
যুদ্ধে যাবার সময় নূর মোহাম্মদ ছিলেন একজন আনসার সদস্য। ছাতকের টেংরাটিলা-মহব্বতপুর এলাকায় ক্যাপ্টেন হেলাল এর অধীনে প্লাটুন কমান্ডার মইন উদ্দিন, শহীদ চৌধুরী, বিল্লাল হোসেন, ৫ নম্বর চেলা সাব সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর অধীনে ছিলেন নূর মোহাম্মদ। 
শহীদ হবার পর নূর মোহাম্মদের স্ত্রী আমেনা খাতুনকে শহীদ পরিবার হিসেবে ২০০০ টাকা করে ভাতা প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সেই ভাতা পাবার সৌভাগ্য হয় আমেনা খাতুনের। তারপর আর কোনো সুযোগ সুবিধা কপালে জুটেনি। 
এরপর আমেনা খাতুন অনেক চেষ্টা করেন, স্বামীর নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার। ঘুরেছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। যতবার চেষ্টা করেছেন, ততবারই শূন্য হাতে ফিরেছেন। অন্যদিকে, গ্রামের কিছু প্রভাবশালী মানুষ তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়। একসময় তাদের বাড়িঘর, জমিজমা দখল করে নেয়। সব হারিয়ে সন্তানাদি নিয়ে পথে বসেন আমেনা খাতুন। এক পর্যায়ে সেই আমেনা খাতুন পাগল হয়ে যান। একবার ঘর থেকে বের হবার পর আর কোনো হদিস মিলেনি সেই নারীর। ২০১৪ সালে শেরপুর থানা পুলিশের মাধ্যমে ছেলে হাসান মিয়া জানতে পারেন, তার মা আমেনা খাতুন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। পুলিশের সহায়তায় তিনি মাকে আহত অবস্থায় নিয়ে আসেন সিলেটে। তারপর কিছুদিনের মধ্যে মারা যান তিনি। 
এদিকে, মায়ের মৃত্যুর পর থেকে হাসান মিয়া বাবার নাম তাালিকাভুক্তি আর নিজের জমিজমা ফিরে পেতে পথে নামেন। কিন্তু বাধা হয় অভাব। পুরনো কাপড় ফেরি করা একজন মানুষ কতটুকুই বা যেতে পারে? সারাদিন পথে পথে ঘুরে দিনশেষে যা হয়, তা’ দিয়ে দু’মুঠো ভাত, দুই মেয়ের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসান মিয়াকে। অন্যদিকে, বাবার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মায়ের নির্মম মৃত্যু, তাকে বড় বেশী পীড়া দেয়। এখন তিনিও ঘুরছেন দুয়ারে দুয়ারে। বাবার নামটি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখার জন্য গত সাত বছরে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট পর্যন্ত ছুটাছুটি করেছেন, এখনো ছুটাছুটি করছেন। 
শহীদ নূর মোহাম্মদের সাথের যোদ্ধাদের মধ্যে যারা এখনো জীবিত রয়েছেন তারাও লিখিত আবেদনে স্বাক্ষর দিয়ে সুপারিশ করেছেন, কিন্তু লাভ হয়নি। দেয়ারাবাজারের তেমনি একজন মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান। 
মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের নাম বলতেই চিনতে ভুল হয়নি তার। তিনি জানান, ‘আমাদের সবার নাম উঠলেও কেন যে নূর মোহাম্মদের নামটা উঠলো না, আমার বিশ্বাস হয়না।’ তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় দোয়ারাবাজার উপজেলার মহব্বতপুর এলাকায় নূর মোহাম্মদ শহীন হন।’
তিনি বিষয়টি নিয়ে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ ইদ্রিস আলীর বীরপ্রতীক এর সাথে আলোচনা করার পরামর্শ দেন। ইদ্রিস আলীর বীরপ্রতীক এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, ‘নূর মোহাম্মদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তভুক্ত করার পত্রে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সুপারিশ করেছেন, সেখানে আমিও স্বাক্ষর করেছি।’