সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি: খাদ্য-আশ্রয়ের জন্য হাহাকার

সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি: খাদ্য-আশ্রয়ের জন্য হাহাকার

রয়েল ভিউ ডেস্ক:
সিলেট ও সুনামগঞ্জের চারদিকে এখন যত দূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। সড়কগুলো হারিয়ে গেছে পানির নিচে। সিলেট মহানগরের বেশিরভাগ এলাকা, সুনামগঞ্জ পৌরশহর পুরোটা এবং দুই জেলার অন্তত ২০টি উপজেলায় বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ৪০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি। বাড়িঘর ডুবে যাওয়ার তাদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছে ঘরের চালা কিংবা কলার ভেলায়। অনেক এলাকায় পানির তোড়ে ভেসে গেছে ঘরের ধান-চাল, আসবাব, গবাদিপশু। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যসংকট। বানের পানিতে কোনোমতে ভেসে থাকা মানুষ উদ্ধারের আর্তি জানাচ্ছে। আবার অনেক এলাকার কোনো তথ্যও মেলেনি তিন দিনে। বিদ্যুৎ ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় কেউ কারও খোঁজ নিতে পারছে না। নৌকাসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযানের সংকটের কারণেও উদ্ধারকাজ ঠিকমতো করা যাচ্ছে না।

পানি বাড়তে শুরু করেছে বিভাগের অন্য দুই জেলায়ও। গতকাল মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সেসব এলাকার হু হু করে বাড়ছে পানি। স্থানীয়দের আশঙ্কা, তাদের অবস্থাও সিলেট-সুনামগঞ্জবাসীর মতোই হতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তর আর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও শুনিয়েছে সেই সতর্কতা। সরকারি এই সংস্থা দুটো বলছে, আগামী তিন দিন অতিভারী বর্ষণ বন্যা পরিস্থিতিকে ভয়ংকর অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। শনিবার ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে সিলেটে।

স্থানীয় প্রশাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট বিভাগে এবার যে বন্যা চলছে বাংলাদেশ ভূখ-ে এমন ভয়াবহ বন্যা দেখা                         

যায়নি ১২২ বছরেও। সিলেট বিভাগের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ার উজানের ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যেও রেকর্ড বৃষ্টিপাতে ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। 

উজানের রেকর্ড ঢল ও টানা বর্ষণে  তিন দিন আগে থেকে শুরু হওয়া বন্যা সিলেট ও সুনামগঞ্জে আরও ভয়াবহ রূপ নেয় গতকাল শনিবার। এ অঞ্চলের ষাট-সত্তরোর্ধ্ব লোকজন বলছেন, তাদের জীবদ্দশায় এমন ভয়াল বন্যা দেখেননি। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র ইতিমধ্যে জানিয়েছে, সিলেট-সুনামগঞ্জের চলমান বন্যা ভয়াবহতার দিক থেকে দেশের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। সিলেট বিভাগের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা এখন বন্যাকবলিত। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, পুলিশসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার লোকজন পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে অবিরাম কাজ করছেন। অবশ্য লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটও চরমে। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকজন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন বন্যার্ত মানুষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার প্রায় শতভাগ এলাকাই এখন ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়কসহ উপজেলার সবগুলো সড়ক পানির নিচে। উপজেলা সদরে অবস্থিত সরকারি অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হাঁটু থেকে গলাসমান পানি। গ্রামগুলো যেন পুরোটাই ডুবে যাচ্ছে। দূর থেকে কেবল গাছপালার পাতা আর ওপরের কিছু অংশ চোখে পড়ে। কোম্পানীগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সাব্বির আহমদ শনিবার সন্ধ্যায় জানান, সিলেট জেলার মধ্যে এই উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ তুলনামূলক নিম্ন আয়ের। তারা পাথর কোয়ারি, পাথর ভাঙার মিলে দিনমজুরের কাজ করেন। এই অভাবী মানুষ বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবনশঙ্কায় রয়েছেন। উপজেলাজুড়ে খাদ্যসংকট চরমে।

কোম্পানীগঞ্জের ইসলামপুর গ্রামের তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘পরিবারের ১২ জন সদস্য নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় আছি। ঘরের মধ্যে কোমরসমান পানি। এর ওপরে বাঁশের মাচা তৈরি করে সেখানে আছি। রান্নাবান্নার কোনো সুযোগ নেই। শুকনো খাবার শেষ হয়ে গেছে। এখন ত্রাণের অপেক্ষায় আছি।’ গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকরের হানিফ মিয়া জানান, পরিবারের নারী-শিশু ও গবাদিপশু জৈন্তাপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে তিনি একটি ছোট নৌকা নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন। তার আধাপাকা ঘরটিও যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে বলে তিনি আশাঙ্কা করছেন। তিনি বলেন, ‘ক্ষেতের ফসল গেছে, ঘরের ধান-চাল, আসবাবও শেষ। এখন যদি ঘরটিও ভেঙে যায় তাহলে আমরা কোথায় যাব।’

সিলেটে বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পানিবন্দি অবস্থায় যারা সংকটাপন্ন, তাদের উদ্ধারে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন মিলে কাজ করছে। গত শুক্রবার থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার সদর উপজেলা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর থেকে কয়েক হাজার লোককে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে আনা হয়েছে। পাশাপাশি ত্রাণসহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। তবে আরও ত্রাণ বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’

সিলেট সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ভয়াবহ বন্যাকবলিত সিলেটের ৩টি ও সুনামগঞ্জের ৫টি উপজেলায় শুক্রবার থেকে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে সেনাবাহিনীর ৯টি ইউনিট। 

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহম্মদ মুশাররফ হোসেন বলেন, ‘সিলেট ও সুনামগঞ্জের চলমান বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে; বিশেষ করে ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জে বড় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অগণিত মানুষ পানিবন্দি। এই বিপর্যয় মোকাবিলায় বিভাগীয়, জেলা ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীও সহায়তায় নেমেছে।’

বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেট নগরীও। নগরীর বেশিরভাগ এলাকার বাসা-বাড়িতে এখন কোমর থেকে গলাসমান পানি। এসব বাসা-বাড়ির মানুষ আত্মীয়ের বাসায়, আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পানি ঢোকায় শনিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো সিলেট ছিল বিদ্যুৎবিহীন। এ জন্য বাসা-বাড়িতে বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েন লোকজন। বেলা ১১টার দিকে নগরীর শিবগঞ্জ খরাদিপাড়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে টিটু চৌধুরী (৩৫) নামের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। বাসায় বন্যার পানি প্রবেশ করায় তিনি জিনিসপত্র বাসার দোতলায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় টেলিভিশনের বিদ্যুৎ লাইন খুলতে গিয়ে তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন।

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্যাকবলিত হওয়ায় গত শুক্রবার থেকেই এখানে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। গতকাল শনিবার সিলেট রেলওয়ে স্টেশনেও পানি প্রবেশ করেছে। যে কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামের সঙ্গে সিলেটের সরাসরি রেলযোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। তবে ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন আসতে পারছে এবং এই স্টেশন থেকে আবার গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও শনিবার বন্যাকবলিত হয়েছে। তবে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া।

এদিকে হবিগঞ্জের তিন উপজেলার ১০ ইউনিয়নও প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বানভাসি মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে স্থানীয় স্কুল-কলেজে আশ্রয় নিয়েছেন।

উপজেলার সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন।  

বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদ্মসেন সিংহ জানান, মুরাদপুর ও দৌলতপুর ইউনিয়নে বন্যার পানি ঘরবাড়িতে প্রবেশ করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা নিরূপণের জন্য সেখানে লোক পাঠানো হয়েছে।

নবীগঞ্জ উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বড় ভাকৈর, ইনাতগঞ্জ, দীঘলবাগ, আউশকান্দি ও কুর্শি ইউনিয়নের ২০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কৈয়ারডালায় ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। ওই ইউনিয়নগুলোর পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।

বন্যা উপদ্রুত এলাকায় জিনিসিপত্রের দাম বেড়ে গেছে। টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে জেলার বিভিন্ন স্থানে শাকসবজির ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বাজারে মাছ ও শাকসবজির দাম বেড়ে যাচ্ছে।

কয়েক দিনের উজানে ভারতীয় এলাকায় বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় মৌলভীবাজারের পরিস্থিতিও খারাপ হয়েছে।

খোয়াই, ধলাইসহ সবগুলো পাহাড়ি ছড়ায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে ধলাই নদীতে যেকোনো সময় পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এদিকে টানা বর্ষণের ফলে উপজেলার টিলাঘেঁষা এলাকাগুলোতে বসবাসকারীদের মাঝে সতর্কতা জারি করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পানিতে গ্রামাঞ্চলে শাকসবজির ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় হাট-বাজারে সরবরাহ কমে গেছে।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কমলগঞ্জের পর্যবেক্ষক সাকিব আহমেদ জানান, ‘উজানে ভারতীয় ত্রিপুরা এলাকায় বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে যেকোনো সময় পানি বেড়ে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। উপজেলা লঙ্গুরপার এলাকায় ধলাই নদীর বাঁধের কিছু অংশে মাটির ধস নেমেছে। সেখানে জরুরি ভিত্তিতে কাজ হচ্ছে।’

ভারী বৃষ্টিপাতের সময় পাহাড়ধসে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গত শুক্রবার বিকেলেই টিলাঘেঁষা কালেঙ্গা, রাজটিলা, ভেড়াছড়া ও বাঘমারা এলাকা পরিদর্শন করে সেসব স্থানের বসতিদের নিরাপদে থাকার সতর্কতা জারি করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিফাত উদ্দীন বলেন, ‘ধলাই নদী ও আশপাশের পাহাড়ি ছড়ায় পানি বেড়েছে। সে পানি এখনো বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন এদিকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে।’

এদিকে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে গ্রামাঞ্চলে শাকসবজির ফসলি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ফলে শনিবার উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে শাক-সবজির সরবরাহ ছিল খুবই কম।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন ফখরুল ইসলাম, শোয়েব চৌধুরী, রুহুল ইসলাম হৃদয় ও অনি চৌধুরী।