সিলেট নগরীর তিন হাজার হকার পুনর্বাসনের আশা

সিলেট নগরীর তিন হাজার হকার পুনর্বাসনের আশা

অবশেষে সিলেট নগরের ফুটপাত হকারমুক্ত হয়েছে। রোজার শুরুর প্রথম দিনেই ফুটপাতে কোনো হকার দেখা যায়নি। নাগরিকদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে অবশেষ সিলেটের সবকটি ফুটপাত হকারমুক্ত করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। তাতে রীতিমতো বদলে গেছে সিলেটের চিরচেনা দৃশ্য। এজন্য নগর কর্তৃপক্ষ এবং মেয়রকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন নগরবাসী। কারণ মেয়র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সড়ক ও ফুটপাত হকারমুক্ত করবেন। তবে পাশাপাশি শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে। তাদের প্রশ্ন- 'কতদিন এমন দখলমুক্ত রাখা যাবে সড়ক ও ফুটপাত।'

সিলেটের ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে চলে যাওয়ায় পথচারীদের হাঁটার জায়গাটুকু ছিল না। ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় হাটতে হতো তাদের। কিন্তু রাস্তায়ও ছিল ভ্যানগাড়ির দখলে। তাছাড়া নানা সময়ে নানা ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে অনেককে। তাই হকারমুক্ত সড়ক ও ফুটপাতের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। তারই প্রেক্ষাপটে গত ১৬জানুয়ারি সিলেট চেম্বার অব কমার্সের অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক অনুষ্ঠানে এক মাসের মধ্যে সিলেটকে হকারমুক্ত করার ঘোষণা দেন নতুন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। কিন্তু এক মাসের মধ্যে তা কার্যকরে ব্যর্থ হন তিনি। এরপর কিছুদিন পর তিনি আরো পনেরদিন সময় নেন। তখন বলেছিলেন, রমজানের আগে সিলেট নগর হকারমুক্ত হবে। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করতে পারায় এখন প্রশংসাও পাচ্ছেন। এর আগে নগরের লালদিঘিরপার এলাকায় সিসিকের পক্ষ থেকে হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। গত সোমবার থেকে সেখানেই ঠাঁই হয়েছে হকারদের।

গতকাল মঙ্গলবার সিলেট নগরের আম্বরখানা, চৌহাট্টা, জিন্দাবাজার, কোর্টপয়েন্ট, বন্দরবাজার, সুরমা মার্কেট পয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে সবগুলো ফুটপাতই হকার মুক্ত। হকারমুক্ত হওয়ায় নগরের অসহনীয় যানজটের তীব্রতাও গতকাল অনেক কম দেখা গেছে।

হকার মুক্ত সিলেট নগর দেখে চিনতেই পারছেন না বলে জানালেন হাসিবুল ইসলাম নামে তরুণ পেশাজীবী। তিনি বলেন, 'নগরকে এমন হকারমুক্ত কখনো দেখিনি আগে। আগের মেয়র হকারমুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। একদিকে হকার সরালে অন্যদিকে হকারদের উৎপাত ছিলই। এবারই প্রথম পুরো নগর হকারমুক্ত দেখলাম। যেন আরেক রূপ নগরের এটি।' অন্তত দশ জন পথচারী নিজেদের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন। মেয়রকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বলেন, 'এই যে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছি স্বাচ্ছন্দ্যে এটা এতদিন আমরা উপলদ্ধিই করতে পারিনি।' একই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সিলেট জেলা বারের আইনজীবী দেবব্রত চৌধুরী লিটন বলেন, 'হকারমুক্ত ফুটপাতের দাবি দীর্ঘদিনের। অবশেষে সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হলো। এই দাবি পূরণ হওয়ায় টাইলসের প্রশস্ত ফুটপাতের সুফল এখন নাগরিকরা পাবেন। যদিও এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ফুটপাত সাময়িকভাবে দখলমুক্ত হতে দেখেছি। পরে একই চিত্র। তাই শঙ্কা থেকেই যায়। আশা করব নতুন মেয়র এটি ধরে রাখতে সক্ষম হবেন।'

পুনর্বাসিত হকাররা আশায়-শঙ্কায়: সিলেট নগরের বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতের হকারদের আগে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ফুটপাত হকারমুক্ত করতে নামে সিলেট সিটি করপোরেশন। নগর ভবনের পেছনের দিকে নগরের লালদিঘিরপার এলাকায় প্রায় চার একর জায়গায় হকারদের পুনর্বাসনের জন্য অস্থায়ী মার্কেট তৈরি করে নগর কর্তৃপক্ষ। যেখানে আড়াই হাজার হকার একসঙ্গে ব্যবসা করতে পারবেন। অস্থায়ী মার্কেট তৈরির পর সেখানে হকারদের আসার আহ্বান জানিয়ে গত সোমবার দুপুর থেকে অভিযানে নামে সিসিক।
লালদিঘিরপার অস্থায়ী মার্কেটে গতকাল মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে সেখানে প্রায় ৩০০ জনের মতো হকার পসরা সাজিয়ে বসেছেন। মাছ, সবজি থেকে শুরু করে জামাকাপড়, জুতাসহ সব ধরণের ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের কেউ নতুন জায়গায় ব্যবসা জমে উঠার ব্যাপারে আশাবাদি আবার কেউ কেউ হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবে সবার বলেছেন, 'ফুটপাতে যে বিকিকিনি হয় তার চার ভাগের একভাগও এখানে করতে পারা যাচ্ছে না।' তেমনই একজন ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম। ২০০১ সাল থেকে তিনি নগরের ফুটপাতে বাচ্চাদের কাপড়ের ব্যবসা করে আসছেন। নতুন জায়গায় ব্যবসা কেমন চলছে প্রশ্নে তিনি বলেন, 'এখানে কেমন হবে আপনি বুঝেন না? রাস্তার ব্যবসা এখানে কখনো হবে? রাস্তায় চলতে চলতে মানুষের একটা জিনিস ভালো লেগেছে কিনে নিয়েছে। এখানে তো প্রয়োজন হলেই কেবল আসবে-নইলে না।' বেলা তিনটা পর্যন্ত ২২০ টাকার বিক্রি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'সাধারণত দিনে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার বিক্রি হয় আমার।' প্যান্ট ও শার্ট বিক্রেতা নিগম চন্দ্র দাস বলেন, 'রাস্তায় সাধারণ পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা বিক্রি করা যেত প্রতিদিন। এখানে সেরকম না। প্রথমদিন সোমবার ১ হাজার ৫০০ টাকা বিক্রি হয়েছিল। আজ বেলা তিনটা পর্যন্ত একটি টাকারও বিক্রি হয়নি।' তবে সব হকাররা যদি এখানে চলে আসেন তাহলে জমে উঠবে বলে আশাবাদি তিনি।

কিনব্রিজের মুখে ব্যবসা করতেন। এখানে এসে এখনো ব্যবসা জমেনি। তবে বেশ আশাবাদি বাবলু রায়। তিনি বললেন, 'প্রায় পনের বছর থেকে কিনব্রিজের মুখে ব্যবসা করি। এখানে কি হবে বুঝতেছি না। তবে আশা করি সব হকাররা যদি নিয়মিত বসেন তবে ব্যবসা হবে।' তিনি আরো বলেন, 'এখানে একটু সম্মান দেয় কাস্টমার। রাস্তায় ৩০০ টাকা বললে কাস্টমার ৬০ টাকা বলে। এখানে একটু সম্মান দিয়ে দেড়শ বলে।' বেলা তিনটার দিকে দোকান সাজাচ্ছিলেন ইকবাল হোসেন। তিনি বললেন, 'রমজানের প্রথম দিন বলে একটু দেরিতে শুরু করেছি। দেখা যাক কি হয়। আল্লাহ ভরসা।'

ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ ও হকারদের পুনর্বাসন সম্পর্কে মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, 'ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ছোট ব্যবসা করে তাদের পরিবার নিয়ে জীবনযাপন করছেন। তারা চুরি-ডাকাতি করেন না। এ জন্য তাদের সম্মানের চোখে দেখতে হবে। হকাররা শুধু হকার নন, আমাদের ভাই আমাদের পরিজন। তাদের সহযোগিতা করতে হবে।' ফুটপাত স্থায়ীভাবে দখলমুক্তর রাখতেই এই পুনর্বাসন কার্যক্রম আগে করা হয়েছে বলে তিনি জানান।